ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগের ওপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারির কারণে উগ্রবাদী ও জঙ্গি সংগঠনগুলো এ কাজে তাদের কৌশল পাল্টেছে। তাদের অনেকে এখন পুরনো দিনের মতো বিশ্বস্ত দূত নিয়োগ করে চিরকুটের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করছে।
উগ্রবাদী সংগঠনের নেতাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো এভাবেই ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। জঙ্গিবাদে অভিযুক্ত সংগঠন ‘আল্লাহর দল’-এর চার সদস্য সম্প্রতি গ্রেফতারের পর র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য দিয়েছে। গতকাল শুক্রবার চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে জঙ্গি কার্যক্রমের চাঞ্চল্যকর তথ্য।

জঙ্গি কার্যক্রম প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিছেন, এক সময় দেশের পুরনো ও নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হুজি ও জেএমবি নিজেদের মধ্যে এভাবে যোগাযোগ করত। তবে প্রযুক্তির প্রসার ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলো নিজেদের যোগাযোগ, মতবাদ প্রচার ও সদস্য সংগ্রহে সেটাও ব্যবহার করছে। তবে সাইবার স্পেসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বেড়ে যাওয়া জঙ্গি গ্রুপগুলো আবার পুরনো যোগাযোগ মাধ্যমই বেছে নিয়ে থাকতে পারে।
র্যাব জানায়, গত ১৮ আগস্ট রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে ‘আল্লাহর দলের’ ভারপ্রাপ্ত আমির ইব্রাহীম আহমেদ হিরো, অতিরিক্ত ‘অধিনায়ক’ ও অর্থ বিভাগের প্রধান আবদুল আজীজ, ঢাকা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘নায়ক’ শফিকুল ইসলাম ও কুড়িগ্রাম জেলার ‘নায়ক’ রশিদুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তিন দিন রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

ওই চারজনকে গ্রেফতারের পর একটি মামলা দায়ের হয়। ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১ এর সহকারী পরিচালক সুজয় সরকার বলেন, জঙ্গি সংগঠনটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ নানা বিষয় জানিয়ে গতকাল চারজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। চারজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো যাচাই করে র্যাব পরবর্তী কার্যক্রম চালাবে।
র্যাব সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে ও জবানবন্দিতে ওই চারজন বলেছে, তাদের সংগঠনের আমির মতিন মেহেদী। তাকে সাংগঠনিকভাবে ‘তারকা’ বলা হয়। ২০০৭ সালে গ্রেফতারের পর থেকে মেহেদী কারাগারে থাকলেও সবকিছু তার নির্দেশেই চলে। চিরকুট এবং কারাগারে দেখার মাধ্যমে মেহেদীর কাছ থেকে নির্দেশনা আসত। নতুন সদস্যরা তার নামেই বাইয়্যাত নিতো। সংগঠনের বন্দিদের ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনাও করছিল।

এ জন্য তাকে কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেওয়ার সময় প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। গ্রেফতার চার জঙ্গি জানিয়েছে, সংগঠনকে চাঙ্গা করতে তাদের আলাদা অর্থ বিভাগও গড়ে তোলা হয়েছিল। আবদুল আজিজের নেতৃত্বে ওই বিভাগে সংগঠনের সদস্যরা ব্যক্তি পর্যায়ে ‘ইয়ানত’ (এককালীন অর্থ) দিত এবং নিজেদের জাকাতের অর্থ ওই তহবিলে জমা রাখত। সন্দেহ এড়াতে সাধারণত সংগঠনের নারী সদস্যদের নামে ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখা হতো।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট র্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আল্লাহর দল’ নামে জঙ্গি সংগঠনটি নামে-বেনামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। এ ছাড়া সংগঠনটি গোপনে কীভাবে সংগঠিত হচ্ছিল, কীভাবে নিজেদের মধ্যে দূত নিয়োগ করে এবং চিরকুটের মাধ্যমে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিল, সে বিষয়ে অনেক তথ্য মিলেছে। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার জঙ্গিরা বলেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে নিজেরা চিঠি ও দূতের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আসছিল।
জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে উত্তরাঞ্চলের জঙ্গি মতিন মেহেদী ওরফে মুমিনুল ইসলাম ওরফে মতিন মাহবুব ‘আল্লাহর দল’ গঠন করে। ২০০৪ সালের শেষের দিকে উগ্রবাদী এই সংগঠনটি অন্য জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সঙ্গে একীভূত হয়। দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের মামলায় জেএমবি কোণঠাসা হয়ে পড়লে মতিন মেহেদীর গ্রুপটি জেএমবি ছেড়ে নিজেরাই সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। ২০০৭ সালে সংগঠনটির প্রধান গ্রেফতার হওয়ার পর এটি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আলোচনা থাকলেও তা হয়নি। দীর্ঘ বছর নীরব থাকার পর ২০১৪ সালে সংগঠনটি কৌশল পাল্টে নিজেদের নাম রাখে ‘আল্লাহর সরকার’।
গত ১৮ আগস্ট সংগঠনটির প্রথম সারির ওই চার সদস্যকে গ্রেফতারের পর র্যাবের ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র লে. কর্নেল এমরানুল হাসান জানিয়েছিলেন, সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ঝামেলা এড়াতে এরা বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিচ্যুত সদস্যদের দলে ভেড়ানোর পরিকল্পনা করেছিল। পিলখানার ঘটনায় চাকরিচ্যুত তৎকালীন বিডিআর সদস্যদেরও দলে ভেড়ানোর চেষ্টায় ছিল তারা। সশস্ত্র সংঘাত ও নাশকতার মাধ্যমে উগ্রবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার অভিপ্রায় ছিল ওই সংগঠনটির।