আমদানি করা পণ্যের পাশাপাশি এ খাতে করপোরেট বিনিয়োগও এসেছে। ফলে কামারদের ব্যবসার পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়ে পড়েছে।
ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চাহিদা থাকে তুঙ্গে। সঙ্গে কাটাকাটির সরঞ্জামের চাহিদাও বাড়ে। ছুরি, চাপাতি ও হাত কুড়ালের মতো পণ্যের বেচাকেনার বড় অংশ এ সময়েই হয়ে থাকে। এসব ধারালো সরঞ্জামের দেশীয় পণ্যের আবেদন আগের থেকে কমেছে। বাড়ছে বিদেশি পণ্যের বাজার।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আমদানি করা পণ্য হালকা গড়নের হলেও শৌখিন ক্রেতাদের কাছে এগুলোর কদর বেশি। ফলে কামারদের ব্যবসার পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়ে পড়েছে। আর লোহা ও কয়লার মূল্যবৃদ্ধিতে দেশে তৈরি পণ্যের দামও বেড়েছে।
গতকাল সোমবার রাজধানীর শাহজাহানপুর, নিউমার্কেট ও কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, কামাররা পণ্য তৈরিতে ব্যস্ত। দোকানে সাজিয়ে রাখা আছে দেশি নানা ধরনের ধারালো সরঞ্জাম। এর মধ্যে আছে চাপাতি, ছুরি, ছোরা, দেশি হাত কুড়াল, স্প্রিং ছুরি, দা ও বঁটি। ছোট চাপাতিও আছে এসব দোকানে। সঙ্গে আছে পাগলু ও বাহুবলী নামের ভিন্ন ধরনের দেশীয় সরঞ্জামও।
এগুলোর দাম ঠিক হয় আকার ও লোহার মানের ওপর নির্ভর করে। পাকা লোহার পণ্যের দাম কাঁচা লোহা থেকে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি। পিস হিসেবে বিক্রির পাশাপাশি এগুলো কেজি হিসেবেও বিক্রি হয়।
আমদানি বাড়ছে
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশীয় ধারালো সরঞ্জামের পাশাপাশি এখন বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের বাজার বাড়ছে। ক্রোকারিজ হিসেবে ধারালো এসব পণ্য আমদানি করা হয়ে থাকে। দেখতে সুন্দর, গড়নে এগুলো হালকা-পাতলা। তবে ধারালো এবং চকচকে। পশুর মাংস কাটার জন্য এগুলো সুবিধাজনক। তবে বড় হাড্ডি কাটতে গেলে ধারালো এসব সরঞ্জাম নষ্ট হয়। নামীদামি রেস্তোরাঁ ও শৌখিন ব্যবহারকারীরা এসব পণ্যের বড় ক্রেতা। তবে এখন কোরবানির ঈদের সময় এসব পণ্য বেশ বিক্রি হচ্ছে।
নিউমার্কেটের কণিকা হার্ডওয়্যারের বিক্রেতা মো. রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘হালকা-পাতলা গড়ন হওয়ার কারণে অনেকে বিদেশি ধারালো সরঞ্জাম চান। আমদানি করা ছুরি, চাপাতি ও চাইনিজ কুড়ালের মতো পণ্য ২০০ থেকে শুরু করে হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে ভারী কাটাকাটি করতে দেশি পণ্যই ভরসা। এ জন্য দুই ধরনের পণ্যই রাখি। আমাদের দোকানে ৬০ শতাংশ দেশি ও ৪০ শতাংশ পণ্য বিদেশি। বেশি বিক্রি কোরবানির সময়েই হয়।’
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, স্থানীয়ভাবে তৈরি প্রতিটি চাপাতির দাম আকারভেদে পড়ছে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। পশুর চামড়া খোলা ও সাধারণ ব্যবহারের ছুরির দাম ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। আর পশু জবাই দেওয়ার ছোরার দাম পড়ছে মানভেদে ৬০০ থেকে হাজার টাকা। দেশি হাত কুড়ালের দাম ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। স্প্রিংয়ের ছুরির দাম শুরু হয় দেড় শ টাকায়। আকারের ওপরে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা দাম পড়ে।
অন্যদিকে পাকা লোহার ভালো মানের একটা দা কিনতে হলে ক্রেতাকে দিতে হবে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। কাঁচা লোহায় তৈরি দা সাড়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। আর বঁটির দাম ৩০০ থেকে হাজার টাকার মধ্যে। মানভেদে পাগলু ও বাহুবলীর দাম পড়ছে ৪০০ থেকে হাজার টাকা। তবে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিতে চাইলে এসব পণ্যের দাম আরও বেড়ে যায়।
কয়লা ও লোহা
দেশের বাজারে এ বছর কয়লা ও লোহার দাম বেশি। ফলে পণ্যের দাম বেড়েছে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা। বছরজুড়ে বেচাকেনা ভালো না থাকায় কামারের পেশা হারিয়ে যেতে বসেছে। আবার আমদানিকারকেরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় ডলারের দাম বেশি থাকায় আমদানি খরচ বেড়েছে, তাই আকারভেদে প্রতিটি বিদেশি পণ্যের দাম ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। চাপ তাদের ওপরেও আছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা বলছে, গত এক বছরে ৬০ ও ৪০ গ্রেডের এসএস রডের দাম বেড়েছে ১৪ শতাংশ। আর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার কয়লার বস্তার দাম এখন দেড় হাজার টাকার বেশি। গ্যাস-বিদ্যুতের দামও এর মধ্যে কয়েক দফায় বেড়েছে।
আক্ষেপ করে শাহজাহানপুর বাজারের কামার অমল দাস বলেন, ‘এই পেশায় আমাদের প্রজন্মই হয়তো শেষ। কারণ, এখন অনেক কোম্পানি ধারালো জিনিসপত্র তৈরি করছে। আবার বিদেশ থেকেও আসছে এসব পণ্য। দেশের বাজারে লোহা ও কয়লার দাম বেশি, তাই বাজারটা আমাদের হাতছাড়া হওয়ার পথে। কোরবানি ছাড়া সারা বছর ব্যবসা হয় না বললেই চলে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা নিউমার্কেটের একজন আমদানিকারক বলেন, বিদেশি পণ্য আগে শুধু শহরের মধ্যে বেচাকেনা হতো। তবে এখন ঢাকার বাইরের ক্রেতারাও এসব পণ্যের চান। সরাসরি বেচাকেনার বাইরে অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে এসব সরঞ্জাম।
করপোরেট বিনিয়োগ
দেশীয় প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল জানিয়েছে, দুটি ব্র্যান্ডের মাধ্যমে তারা এ–জাতীয় পণ্য বাজারজাত করছে। ৪৫ টাকা থেকে শুরু করে ৩৫০ টাকার মধ্যে ধারালো ছুরি বা ছোট চাপাতির মতো পণ্য বিক্রি করে থাকে তারা। এসব পণ্য তাদের বিক্রয়কেন্দ্র ছাড়া বাসনকোসন বিক্রির দোকানেও পাওয়া যায়। দেশীয় শিল্প বিকাশের সুযোগ দিতে আমদানি করা ধারালো সরঞ্জামের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের দাবি জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে এই ব্যবসার আকার কত হতে পারে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এ বছর কোরবানির পশুর সম্ভাব্য চাহিদা ১ কোটি ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯টি। তার মধ্যে ৪৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৫২ গরু-মহিষ, ৭৬ লাখ ৯০ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং ২ হাজার ৫৮১টি অন্যান্য প্রজাতির গবাদিপশু। এসব পশুর বেশির ভাগই এক দিনে জবাই করা হয়। চামড়া ছাড়ানো থেকে শুরু করে মাংস কাটাকাটিও মোটামুটি একই সময়ে হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি পশুর জন্য তিন থেকে পাঁচটি ধারালো সরঞ্জামের দরকার হয়। তাতে মোটামুটি ৫০০ থেকে হাজার টাকা দামের সরঞ্জামে লাগে। এর বাইরে বাসাবাড়িতে ব্যবহারের জন্যও ধারালো এসব সরঞ্জামের দরকার হয়। ফলে এ–জাতীয় পণ্যের বাজার কয়েক হাজার কোটি টাকার নিচে নয়। তবে এসব সরঞ্জাম অবশ্য একবার কিনলে কয়েক বছর ব্যবহার করা যায়।
নিউমার্কেটে বঁটি কিনতে আসা আকলিমা খাতুন বলেন, ঈদের দিন একসঙ্গে অনেক মাংস কেটে ফ্রিজে রাখতে হয়। একটি বঁটিতে কাজ হয় না, তাই আরেকটা বঁটি নিতে এসেছি।