বিপ্লবী ও বাস্তববাদী জাফরুল্লাহ চৌধুরী

0
114
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর

আমি গাড়িতে চড়ে ঘুমিয়ে পড়লে প্রায়ই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কথা ভাবি। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি আমার অভ্যাস। বাংলাদেশে আমাদের দীর্ঘ সফরের সময় তিনি কীভাবে চালকের পাশে বসে সামনের আসনে ঘুমিয়ে পড়তেন, তা মনে করিয়ে দেয়। আমার এক বন্ধু এক দিন আমাকে তাঁর সম্পর্কে কিছু লিখতে বলবে– সেটা ছিল আমার কাছে অকল্পনীয়। বাংলাদেশ এবং সারাবিশ্বে আক্ষরিক অর্থেই লাখ লাখ মানুষ রয়েছে, যাদের তিনি স্পর্শ করেছিলেন শরীর, মন এবং আত্মায়।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাকারী অগ্রগামী চিকিৎসক জাফরুল্লাহ চৌধুরী কয়েক মাস অসুস্থতার পর গত ১১ এপ্রিল মারা যান। ভালো বিষয় হলো, ঢাকায় তাঁরই প্রতিষ্ঠিত  গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে তিনি তাঁর শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন। গণস্বাস্থ্যের কর্মীরা তাঁর খুব যত্ন করেছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। অনেকেই তাঁকে বাংলায় শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন, যে ভাষায় তিনি আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সত্য কথা বলতেন। আমার দত্তক নেওয়া বাংলাদেশি বোন স্বল্পশিক্ষিত একজন উচ্চ বুদ্ধিমান নারী, টেলিভিশনে তাঁর (জাফরুল্লাহ) ঘন ঘন উপস্থিতি দেখার পর আমাকে বলেছিলেন, ‘জাফরুল্লাহ সব সময় সত্য বলেন।’ তাই তাঁর প্রধান যে বিষয়টি আলোচনা হওয়া উচিত সেটি হলো তাঁর সাহস।

বাধা মাড়িয়ে চলা

জাফরুল্লাহর সত্যকথন তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিল। তিনি ছিলেন আগ্রহী পাঠক। তিনি অতীতের জরুরি সামাজিক বিষয়গুলো দেখতে পেতেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সক্রিয়ভাবে পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং নারীর কর্মসংস্থানের প্রতিবন্ধকতা ভেঙে দিয়েছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রমাণ করেছে– এমনকি দরিদ্র নারীরাও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এমন কাজ করতে সক্ষম, যেগুলো আগে শুধু পুরুষের কাজ হিসেবে পরিগণিত হতো। জাফরুল্লাহ মনে করতেন, আত্মবিশ্বাসী নারীরা লিঙ্গবাদের বেড়াজালের বাইরে মুক্ত পরিবেশে বড় কাজ করতে পারে।

একজন বাস্তববাদী হিসেবে তিনি অনুধাবন করেছিলেন, স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্যারামেডিকরা সাইকেল চালালে তাঁরা আরও দ্রুততার সঙ্গে সেবাগ্রহীতার কাছে পৌঁছাতে পারবেন। ধর্মীয় রক্ষণশীলদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বাংলাদেশে নারীদের সাইকেল চালানোর ব্যাপারে অগ্রগামী। ১৯৭৭ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই আত্মবিশ্বাসী নারীরা সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ঢাকা পর্যন্ত ২৫ মাইল সাইকেল চালিয়েছিলেন।

সাইকেলের বাধা ভাঙা ছিল জাফরুল্লাহর শুরু। তিনি নারীদের গাড়ি চালানোর ওপরেও জোর দিয়েছিলেন! ফলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চালকদের সিংহভাগই ছিলেন নারী। বাংলাদেশে সেটি ছিল ব্যতিক্রম। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে নম্র মানুষের গাড়ি চালানো কঠিন। তবুও বিশৃঙ্খল ট্রাফিকের মধ্যে গণস্বাস্থ্যের চালকরা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।

সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ক্যাম্পাস এখন একটি বিস্তৃত কমপ্লেক্স। যার শুরু হয়েছিল অনুর্বর জমিতে হাতে গোনা কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মীর তাঁবুতে বসবাসের মধ্য দিয়ে। নিরাপত্তার বিষয়টি শুরু থেকেই ছিল উদ্বেগের। এটি ছিল ছিনতাইকারী ও অপরাধীদের এলাকা। এমনকি গণস্বাস্থ্যের কর্মীরাও একাধিকবার ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছিলেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী নারীদেরই নিরাপত্তার দায়িত্বে রেখেছিলেন! তাঁরা ছিলেন শক্তিশালী এবং আত্মবিশ্বাসী, যাঁরা প্রবেশে নিরাপত্তা যাচাই এবং পুরো সীমানা সুরক্ষিত রাখতেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে নারী নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য পরিবেশ যত স্বাভাবিক মনে হয়, দেশের অন্য কোথাও তেমনটা দেখা যায় না।

অত্যন্ত বাস্তববাদী

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বাস্তববাদের বীজ মুক্তিযুদ্ধের সময় বপন করা হয়েছিল এবং স্বাধীন বাংলাদেশে তা প্রস্ফুটিত হয়। প্রশিক্ষিত নারী প্যারামেডিকরা অস্ত্রোপচারের কাজ করতেন এবং তাঁদের কাজে চিকিৎসকদের তুলনায় কম সংক্রমণ হতো। তাঁরা সুপারভাইজার, ফার্মাসিস্ট, চালক, নিরাপত্তাকর্মীর গার্ড এমনকি ধাতব কারখানার শ্রমিক হিসেবেও কাজ করতেন। তাঁরা ছোট পর্যায়ে উৎপাদন করতেন এবং কারখানা চালাতেন। তাঁরা নতুন দক্ষতা শিখেছিলেন এবং উচ্চ স্তরের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কমিউনিটি হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্রবর্তনসহ স্বাস্থ্যসেবায় অসংখ্য উদ্ভাবনের পথপ্রদর্শক। ধনী লোকজন উচ্চ প্রিমিয়াম দেয় এবং দরিদ্ররা সামান্য অর্থ প্রদান করে। তবে সবাই মানসম্পন্ন ও যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পায়।
জাফরুল্লাহ জাতীয় ঔষধনীতির মাধ্যমে ফার্মাসিউটিক্যালসের ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সফলভাবে লড়াই করেছিলেন। নীতিমালার আগে কিছু বহুজাতিক কোম্পানি ওষুধ তৈরি ও বিতরণ ব্যবস্থায় একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিল। ফলে ওষুধের দাম ছিল ব্যয়বহুল ও অযৌক্তিক। সেখানে জাতীয় ঔষধনীতি বাংলাদেশি ওষুধ শিল্পের বিকাশে ভূমিকা পালন করেছিল। জাফরুল্লাহ গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস তৈরির তত্ত্বাবধান করেছেন এবং কম দামে ওষুধ উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছেন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গত ৫০ বছরে যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তা জাফরুল্লাহর সীমাহীন শক্তি, স্বপ্ন এবং দূরদর্শিতার ফসল। তিনি কোনো সমস্যা দেখলে তার সমাধান বের করেছেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বাংলাদেশজুড়ে ১০ লক্ষাধিক মানুষকে সেবা দিয়েছে। গণস্বাস্থ্যের একটি বড় হাসপাতাল রয়েছে রাজধানী ঢাকায়। সেখানে সাশ্রয়ী মূল্যে হেমোডায়ালাইসিস, অগ্নিদগ্ধের চিকিৎসা এবং প্লাস্টিক সার্জারি, শারীরিক থেরাপি, চক্ষু রোগ, জরুরি চিকিৎসা, আয়ুর্বেদিক ওষুধসহ আরও সেবা প্রদান করে। সাভারে রয়েছে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ এবং গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

জাফরুল্লাহ বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি ৭০টিরও বেশি দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় ভূমিকায় ছিলেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ক্যাম্পাসে দুটি জনস্বাস্থ্য সম্মেলনে ৯০টিরও বেশি দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ সাভারে এসেছিলেন।

নিখুঁত জোড়া

যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্টে আমার বাড়ির কাছের বাগানে একাকী হাঁটার সময় কী লিখতে হবে, তা ভাবতে গিয়ে আমার এই উপলব্ধি এসেছিল– জাফরুল্লাহর জীবন সম্পর্কে কথা বলতে হলে শিরিন হককে স্বীকার করতে হবে। শিরিন হক অক্লান্ত পরিশ্রমী এবং নারী অধিকারের জন্য অগ্রণী কণ্ঠস্বর। আমার মনে আছে, ১৯৯২ সালে শিরিন এবং জাফরুল্লাহকে একসঙ্গে দেখা ছিল আনন্দদায়ক বিস্ময়। কারণ তাঁদের উভয়কে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। আমি প্রায়ই তাঁদের এই বলে খোঁচাতাম– ‘শিরিন, তুমি এমন একজনকে বিয়ে করতে পারলে!’ কিন্তু বাস্তবে তাঁরা একটি নিখুঁত জোড়া ছিলেন এবং তাঁরা একে অপরকে শক্তিশালী করেছিলেন।

জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভাবছিলেন, তাঁর কাজটি সম্পন্ন করা দরকার। ৫০ বছরেরও বেশি সময় মা ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য চ্যাম্পিয়ন হয়ে তিনি বলেছিলেন, আমাদের অবশ্যই প্রবীণদের কথা ভাবতে হবে এবং বাংলাদেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু করা উচিত। তিনি যদি আরও বেশিদিন বেঁচে থাকতেন, আমি হয়তো দেখতাম, তিনি প্রবীণের স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা নিশ্চিত করার নতুন কোনো উপায় খুঁজে পেয়েছেন।

যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, জাফরুল্লাহর কথা ভাবতে গিয়ে আমার গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়ার সেই বিষয়ে ফিরে আসি। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমী ছিলেন এবং সে জন্য প্রায়ই কোথাও যাওয়ার সময় নিজেকে ঘুমানোর সুযোগ দিতেন। তাঁর কাজের নীতি আমাকে এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অনেক নিবেদিত কর্মীকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

যদিও এত দীর্ঘ সংগ্রামের পর জাফরুল্লাহর অনুপস্থিতি এখনও অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে। আমি নিশ্চিত যে, সময়ের সঙ্গে সচেতনভাবে বা অচেতনভাবে তাঁর সঙ্গে আমাদের সংযোগ ঘটবে এবং আরও দৃঢ় হবে।

স্টিভ মিনকিন: যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী গবেষক ও ইতিহাসবিদ; মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের বন্ধু; দ্য ডেইলি স্টার থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.