চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে দেশীয় শিল্প খাত

0
146

দেশীয় শিল্পের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে ‘শুল্ক প্রতিরক্ষণ’ হার ধাপে ধাপে কমাতে হবে। পাশাপাশি শুল্ক রেয়াত সুবিধা পরিহার করতে হবে। তবে ভোক্তার কল্যাণে আমদানি শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। এসবসহ আরও বিধিবিধান অন্তর্ভুক্ত করে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি-২০২৩’ (জাতীয় শুল্কনীতি) গেজেট জারি করেছে।

বিধিতে আরও বলা হয়, পণ্য আমদানির কারণে শিল্পের ক্ষতি হয়, সেটি লাঘবে ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’, ‘কাউন্টারভেইলিং’ ও ‘সেফ গার্ড’ শুল্ক আরোপের মাধ্যমে সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

সূত্রমতে, এটি দেশের প্রথম শুল্কনীতি। এটি প্রণয়নে তাগিদ ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১০ আগস্ট জাতীয় শুল্কনীতির গেজেট জারি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে এই শুল্কনীতি দেশি শিল্পকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে বলে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞমহল। কারণ, বিগত সময়ে নানা ধরনের সুরক্ষা পেয়ে দেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আগামী দিনগুলোয় এই নীতিমালার আওতায় সুবিধা ও সুরক্ষাগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়া হবে।

জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব নুসরাত জাবীন বানু জানান, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এই ট্যারিফ পলিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর  বলেন, এটি ১০ থেকে ১৫ বছর আগেই করা দরকার ছিল। বর্তমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শুল্ক নির্ধারণ করে দেয়। এটি ভুল পলিসি। এটি করবে ট্যারিফ কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাস্তবায়ন করবে এনবিআর। এটি নিয়ে শিল্পোদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বিরোধিতা আসবে। কারণ, শিল্প খাত সুরক্ষা পেয়ে অভ্যস্ত। সুরক্ষা কমিয়ে দিলে তাদের অসুবিধা হওয়ার কথা। কিন্তু রপ্তানির বহুমুখীকরণ, বাজার সম্প্রসারণ, বাণিজ্য নিগোসিয়েশন, বড় দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি এবং নির্ভরশীলতা কমাতে হলে এই পলিসি দরকার আছে। দেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যে একই পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি হলেও টিকে থাকা যাবে।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন জিটু বলেন, এ নীতিতে শিল্প খাত আগামী দিনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কারণ, সুরক্ষা শুল্ক শিল্প খাত থেকে পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়া হলে বিদেশি পণ্যের কাছে টিকে থাকতে হিমশিম খেতে হবে। আমদানি পণ্যের শুল্ক কমালে অনেক পণ্য দেশের বাজার দখল করে নেবে। এসব বিষয়ও ভাবতে হবে।

জানা যায়, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এটি প্রথম জাতীয় শুল্কনীতি প্রণয়ন করা হলো। এর আগে আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে শুল্কহার নির্ধারণ ও হ্রাস-বৃদ্ধিসহ সব চলছে অস্থায়ী ভিত্তিতে (অ্যাডহক)। এই শুল্কনীতি প্রণয়নের তাগিদ প্রথম দিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটি বলেছে, অনেক পণ্য আমদানিতে এখনো বাংলাদেশের শুল্কহার বেশি এবং কাঠামো জটিল। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে থাকার সময়ে বিদ্যমান শুল্কহার যৌক্তিক করা দরকার। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ গ্রহণ করে এ ধরনের একটি জাতীয় শুল্কনীতি প্রণয়নের।

সূত্র জানায়, নতুন জাতীয় শুল্কনীতির আওতায় ছয় মাসের মধ্যে দেশের বিদ্যমান শুল্কহার যৌক্তিকীকরণের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পাশাপাশি এর বাস্তবায়ন মনিটরিং করতে বাণিজ্যমন্ত্রীকে প্রধান করে ১৬ সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জাতীয় শুল্কনীতিতে। আর সদস্য হিসাবে থাকবেন পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প, অর্থ এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব। এছাড়া অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবরাও এর সদস্য হিসাবে থাকবেন।

জাতীয় শুল্কনীতিতে যা আছে : বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি পর্যায়ে মোট শুল্ক ও কর আরোপোর হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত পণ্য ও সেবা এবং আমদানিকৃত পণ্যের ওপর আরোপিত সম্পূরক শুল্ক এবং মূল্য সংযোজন করকে (ভ্যাট) ‘বাণিজ্য নিরপেক্ষ কর’-এ পরিণত করতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাণিজ্য নিরপেক্ষ কর হচ্ছে আমদানি পণ্যের শুল্ক বা কর, যা সমানভাবে স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যের ওপর আরোপ করা হয়। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে শুল্ক ছাড় সুবিধা রয়েছে। শুল্কনীতিতে বলা হয়েছে, ব্যবহারকারীভিত্তিক শুল্ক রেয়াত সুবিধা পরিহার করতে হবে। অর্থাৎ আগামী দিনে অনেক ক্ষেত্রে শুল্ক রেয়াত সুবিধা থাকছে না। সরকার অনেক সময়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বিদেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করে থাকে। সেটিকে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কব্যবস্থা বলা হয়।

শুল্কনীতিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কেবল জরুরি পরিস্থিতিতে এটা আরোপ করা যাবে। সেখানে আরও বলা হয়, প্রয়োজনে কোনো কোনো পণ্যের ওপর মিশ্র এবং সিজনাল শুল্ক আরোপ করতে হবে। এখানে সিজনাল শুল্ক হলো কৃষিপণ্যের পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হারে আরোপিত শুল্ক, সেটির হার মৌসুমে সর্বোচ্চ থাকবে। এছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় বাংলাদেশ আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ও করহার একটি নির্দিষ্ট অঙ্কে রাখার অঙ্গীকার করেছে। এখানেও এর সঙ্গে মিল রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে মিল রেখে ন্যূনতম আমদানি মূল্য ব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে বলা হয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী সুপারিশের ভিত্তিতে সম্ভাবনাময় শিল্প, নতুন পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প স্থাপন ও শিশু শিল্পের জন্য সময়াবদ্ধ প্রতিরক্ষণ দিতে হবে। শুল্কনীতিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মধ্যম উদ্যোক্তা (এমএসএমই) শিল্পকে। সেখানে এমএসএমই শিল্পের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।

এছাড়া আমদানি ও রপ্তানি নীতি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় উভয় বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প রয়েছে। এর মধ্যে শুধু রপ্তানির উদ্দেশ্যে উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শুল্ক ও করের বিপরীতে শতভাগ ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে বন্ড সুবিধা প্রদান করতে হবে। তবে শর্ত হচ্ছে, রপ্তানির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৭০ ভাগ কাঁচামাল আমদানির বন্ড সুবিধা প্রাপ্য হবে।

সেখানে আরও বলা হয়, কোনো রপ্তানি পণ্যের উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের ৭০ শতাংশের বেশি হলে বর্ধিত অংশের জন্য প্রচলিত নীতি অনুযায়ী শুল্ক প্রত্যাপন প্রাপ্য হবে। এই নীতিতে বলা হয়েছে, দেশের আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে আরোপিত ট্যারিফকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রবাহের নিয়ামক হিসাবে দেখতে হবে। এছাড়া জাতীয় শুল্কনীতিতে দেশের শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প ও প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারকদের বন্ড ব্যবস্থা সংস্কার করতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে বন্ড সুবিধা পাওয়া ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে অধিক স্বচ্ছতা ও সহজ করতে বলা হয়। এছাড়া বিদ্যমান শুল্ক কাঠামো আরও সহজ করা এবং শুল্ক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে ওই নীতিতে।

জাতীয় শুল্কনীতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য : এই নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বলা হয়, এতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ অথনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে। এছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ এবং অর্থনীতিতে বৈশ্বিক আঘাত মোকাবিলা করা যাবে। এছাড়া বাণিজ্য উদারীকরণ ও ট্যারিফ কাঠামোকে যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে দেশীয় শিল্পকে শক্তিশালী করতেই এই নীতি প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়, এন্ট্রি এক্সপোর্ট ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে রপ্তানি সম্প্রসারণ ও বহুমুখীকরণ, শুল্ক নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং স্থানীয় বাজারে পণ্যমূল্যের অসামঞ্জস্য হ্রাস, মাত্রাতিরিক্ত প্রতিরক্ষণ বোঝা কমিয়ে ভোক্তার কল্যাণসাধন, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভ্যালু চেইনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করবে এই শুল্কনীতি।

শুল্কনীতি প্রণয়নের প্রেক্ষাপট : গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সময়ে রাজস্ব ক্ষতি কমানো এবং স্থানীয় শিল্পকে রক্ষায় আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ বৃদ্ধি পায়। এটি ২০২২-২৩ অর্থবছরে গড় আমদানি শুল্কহার ১৫ দশমিক ০৯ শতাংশ দাঁড়ায়। একই সময়ে গড় প্রতিরক্ষণ শুল্ক হার ৩০ দশমিক ৫৮ শতাংশে উঠেছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) হিসাব অনুযায়ী তা নামিয়ে আনতে হবে ২৫ শতাংশে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.