চোখের সামনে ভেসে গেল ভাই-বোন

0
456
সবার চোখের সামনেই পদ্মা নদীতে তলিয়ে যায় দুই ভাই–বোন।

বাবা-মায়ের সঙ্গে নানা বাড়িতে ঈদ করতে গ্রামে গিয়েছিল মো. শরিফ (১৭) ও মাহফুজা আক্তার (১৪)। মামাতো-খালাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দে মেতে ছিল তারা।

দুপুরে নানা বাড়িতে সব স্বজনেরা আসবেন। এক সঙ্গে খাবার খাবেন। খাওয়া-দাওয়া শুরুর আগে সব ভাই-বোন মিলে পদ্মায় গোসল করতে নামে তারা। বাকিরা ফিরে আসলেও এই দুজন তলিয়ে যায় পদ্মায়। সবার চোখের সামনে তারা তলিয়ে গেলও কারওরই কিছুই করার ছিল না। ঘটনার প্রায় ৫ ঘণ্টা পরে ডুবুরিরা দুজনের নিথর দেহ তুলে আনেন। ঈদ আনন্দে মেতে থাকা পরিবারটিতে মুহূর্তে নেমে আসে বিষাদের ছায়া।

মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার দুর্গম পদ্মার চর নওপাড়া মুন্সিকান্দি গ্রামে। পদ্মায় তলিয়ে মারা যাওয়া মো. শরিফ ও মাহফুজা আক্তার ওই গ্রামের আবদুল হক ব্যাপারীর ছেলে। শরিফ ঢাকার মিরপুরের একটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আর মাহফুজা মিরপুরের একটি মাদ্রাসার নবম শ্রেণির ছাত্রী।

মঙ্গলবার দুপুরে শরিফ ও মাহফুজা তাদের মামাতো ও খালাতো ভাই বোনদের সঙ্গে পদ্মা নদীতে গোসল করতে যায়। দুপুর আড়াইটার দিকে সাঁতার কাটতে গিয়ে দুই ভাইবোন স্রোতের তোড়ে পড়ে। অন্যরা তাদের উদ্ধার করতে চেষ্টা করে। ততক্ষণে তারা পানিতে তলিয়ে যায়। খবর পেয়ে স্বজনরা নদীতে তাদের খোঁজাখুঁজি করেন। পরে নারায়ণগঞ্জ থেকে ডুবুরি এনে তাদের খুঁজে বের করা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মুন্সিকান্দি গ্রামের পদ্মা নদী থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

শরিফ ও মাহফুজার বাবা আবদুল হক ব্যাপারীর বাড়ি মুন্সিকান্দি গ্রামেই। তিনি ছোটবেলা থেকে ঢাকার মিরপুরে থাকেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটি ভাড়া করা বাসায় থাকেন। সিএনজি চালক আবদুল হক রোববার পরিবার নিয়ে শ্বশুর বাড়ি নওপাড়া মুন্সিকান্দিতে আসেন। ওই বাড়ির পাশেই পদ্মা নদী। দুপুরে সন্তানরা যখন পদ্মায় যায় তিনিও তখন তাদের সঙ্গে যান। সন্তানরা বেশি সময় নিয়ে গোসল করায় তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়ি পৌঁছার আগেই ছেলে মেয়ে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে এমন চিৎকার শুনতে পেয়ে দৌড়ে নদীতে যান। ততক্ষণে ছেলে মেয়ে তলিয়ে যায়। নদীতে নেমে ওই স্রোতের মধ্যেই সন্তানদের খুঁজতে থাকেন। ততক্ষণে খবর পেয়ে অন্য স্বজনরাও তাদের খুঁজতে পদ্মায় নামেন।

আবদুল হক বলেন,আমি ফেরার সময় তাদের নদী থেকে উঠতে বলেছিলাম। তারা আমার কথা না শুনে নদীতে আনন্দ করার জন্য থেকে যায়। আমি বিরক্ত হয়ে বাড়ির দিকে রওনা হই। আমিতো ভাবতে পারিনি ওরাই আমার সঙ্গে অভিমান করে সারা জীবনের জন্য চলে যাবে।আমিই ওদের নদীতে নিয়ে এসেছিলাম। আমিই ওদের নদীতে বিসর্জন দিয়ে গেলাম। এখন ওদের মাকে কি জবাব দেব? আল্লাহ কেন আমাদের সন্তানদের নিয়ে গেলেন?

শরিফ ও মাহফুজার সঙ্গে গোসল করছিল তাদের খালাত বোন রিয়া। সে প্রথম আলোকে জানায়,খালু (আবদুল হক) যখন নদী থেকে ফিরে বাড়ি যাচ্ছিল তখন শরিফ ভাই ও মাহফুজা সাঁতার কাটতে থাকে। হঠাৎ দেখি তারা ভেসে যাচ্ছে। আমি দ্রুত চিৎকার দিয়ে খালুকে ডাকি। খালু আসতে আসতে তারা পানিতে তলিয়ে যায়। আমাদের চোখের সামনে ভাই-বোন তলিয়ে গেল। কিছুই করতে পারছিলাম না।

শরিফ ও মাহফুজার নানা আবদুল হাই দেওয়ান বলেন, ঈদ উপলক্ষে ছেলে-মেয়ে ও তাদের সন্তানরা বাড়িতে এসেছে। বাড়ি আনন্দ উৎসব। দুপুরে রান্না হচ্ছিল। ওরা নদী থেকে ফিরলেই এক সঙ্গে বসে সবার খাবার খাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওদের হারিয়ে যাওয়ার খবরটি কেউ মানতে পারছি না। ফুলের মতো দুটি ছেলে-মেয়ে মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে গেল তা কি মেনে নেওয়া যায়?

নওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ আজগর সোহেল মুন্সি বলেন,পদ্মায় ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যুর ঘটনাটি কেউ মেনে নিতে পারছে না। ওই পরিবার শুধু নয়, গ্রামের মানুষের ঈদের আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়েছে।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, নওপাড়া চতুর্দিকর পদ্মা নদী দিয়ে বেষ্টিত। অনেক দুর্গম চর। দুই শিক্ষার্থী পদ্মায় ডুবে গেছে এমন খবর পেয়ে ডুবুরি খবর দেওয়া হয়। ডুবুরিরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে ওই দুই শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করেছে। তিনি বলেন, পরিবার চাইলে তাদের সকল ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.