শাহরিয়া শামীম পায়ের একটা অংশ হারিয়েছিলেন নয় মাস বয়সে। অসুখটার কথা আজও জানতে পারেননি তিনি। প্রচণ্ড জ্বর, হাসপাতালে নিতে নিতেই খসে পড়ল শিশু শামীমের পায়ের একটা অংশ। সেই শামীম এখন বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য সদস্য। কিন্তু তিনি হতাশ তাঁর ক্রিকেটার জীবন নিয়ে!
একটু জ্ঞান হতেই দেখলেন তাঁর একটি পায়ের নিচের দিকের অংশ নেই। নেই হাতের আঙুলের কিছু অংশও। বাকি সবার জীবন যেমন, তাঁরটা ঠিক তেমন নয়। মা, ভাইকে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর পান না। তাঁরা বলেন, খুব ছোটবেলায় তোমার অসুখ করেছিল, তারপর থেকেই এ অবস্থা। অসুখটা আসলে কী করেছিল?
নয় মাস বয়সে আকাশ-পাতাল জ্বর, হাসপাতালে নিতে নিতেই চোখের সামনে খসে পড়ল ছোট্ট শিশুটির এক পায়ের নিচের দিকের অংশ। হাতের কয়েকটি আঙুলের কিছু অংশ। সবাই অবাক! কী এমন হলো বাচ্চাটার যে এমন সর্বনেশে পরিণতি। জ্বর তো কতজনেরই হয়!
বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান তিনি। শাহরিয়া শামীম নিজেও জানেন না ছোটবেলায় তাঁর আসলে কী হয়েছিল। অনেককে জিজ্ঞেস করেছেন, কিন্তু সদুত্তর পাননি। জ্বর থেকে কারও শরীরের অংশ বিলীন হয়ে যেতে পারে! এ জীবনে তো আর কারও এমন দেখেননি! তাঁর নিজের কেন এমন হলো!
শামীমের বয়স এখন ৩২। নিজেকে প্রশ্ন করেও উত্তর পাননি। চলতে-ফিরতে অসুবিধা থাকলেও ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের ভীষণ নেশা। বিশেষ একধরনের জুতো পরেই ক্রিকেট খেলতেন। ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ আর নেশাটা তাঁকে নিয়ে এসেছে শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলে। সেই ২০১৫ সাল থেকেই দেশের অন্যতম সেরা শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আন্তর্জাতিক রেডক্রস (আইসিআরসি) কিছুকাল আগে তাঁকে সোজা হয়ে চলে ফিরে বেড়ানোর জন্য একটি নকল পা দিয়েছে। সেটি দিয়ে চলছেন, ক্রিকেট খেলছেন। কিন্তু শামীম এখন ছেড়ে দিতে চান ক্রিকেট। কেন?
ইংল্যান্ডে ফিজিক্যাল ডিজঅ্যাবিলিটি ওয়ার্ল্ড সিরিজ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ হেরেছে নিজেদের প্রথম তিনটি ম্যাচই। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটি মাঠেই গড়াতে পারেনি বৃষ্টি-বাধায়। দল ভালো করেনি। কিন্তু শামীম কিন্তু ঠিকই নিজের জাতটা চিনিয়েছেন। প্রতিটি ম্যাচেই তিনি নিজেকে দলের নির্ভরতা হিসেবে প্রমাণ করেছেন। কিন্তু দল ভালো করছে না দেখে তিনি নিজের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সকে পাত্তাই দিতে চান না। তবে এবার দলের পারফরম্যান্সের হতাশার সঙ্গে তাঁর মধ্যে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু। এত দিন পর তিনি ভাবতে বসেছেন, এই যে ক্রিকেট খেলছি শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে। কিন্তু আখেরে কী লাভ হচ্ছে! দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা আর বিদেশ-টিদেশ সফর করা, এই? দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার মধ্যে আনন্দ আর গর্বের একটা ব্যাপার আছে তা ঠিক কিন্তু দিন শেষে জীবনসংগ্রামে টিকে থাকাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
শামীম এখন ভাবছেন এটি নিয়েই, ‘ইদানীং খুব কষ্ট হচ্ছে ক্রিকেট খেলতে। নকল পা পরে আর কত খেলা যায়! দিন শেষে এটা একটা খেলা। শারীরিক শক্তির একটা ব্যাপার থাকে। সেটা না হয় দেশের কথা মাথায় নিয়ে হাসিমুখে করে দিলাম। কিন্তু কোনো টুর্নামেন্ট শেষ যখন নামমাত্র অর্থ পাই, তখন নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। তখন মনে হয়, নাহ্, এবার ক্রিকেট নিয়ে আর মাথা ঘামানো নয়, অন্য একটা চাকরি জুটোতে হবে।’
এটি বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের গোটা চিত্রই। শামীম উদাহরণ টানেন ফিজিক্যাল ডিজঅ্যাবিলিটি ওয়ার্ল্ড সিরিজে অংশ নেওয়া প্রতিটি দলেরই, ‘ইংল্যান্ডের মতো দেশের শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটাররা যেভাবে বুক ফুলিয়ে জীবন-যাপন করে, সেটা দেখে খুব খারাপ লাগে। আমরা কী দোষ করেছি। ওদের সুযোগ-সুবিধার কাছে আমরা ডাল-ভাত। ইংল্যান্ডের কথা বাদ দিন , ভারত, পাকিস্তান এমনকি আফগানিস্তানও যে সুযোগ-সুবিধা পায় তার ধারেকাছেও আমরা নেই। আইসিআরসি অনেক করেছে আমাদের জন্য। কিন্তু ক্রিকেট বোর্ডকে তো এগিয়ে আসতে হবে। এবার দেশে গিয়ে খেলাটা ছেড়েই দেব!’
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর ছেলে শামীম ডিগ্রি পাস করেছে। ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহ ছিল বলেই শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটের প্রতি একসময় আকৃষ্ট হলেন। মনপ্রাণ ঢেলে খেলেছেন। এতটাই ভালোবেসেছেন যে আলাদা করে চাকরি-বাকরির খোঁজ করেননি। কিন্তু এখন তাঁর মনে হচ্ছে, কাজটা ভুলই করেছিলেন।
আইসিআরসি একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের দেখভালের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু সেদিন প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বললেন, ‘সময় এসেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) আরও কার্যকর পদক্ষেপের। দিন শেষে আমরা একটি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা। কোনো ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান নই। আমরা হয়তো দেশের শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারদের একটা জায়গা পর্যন্ত আমরা সাহায্য করতে পারব। কিন্তু খেলাটায় পূর্ণ পেশাদারি আনতে বিসিবির কার্যকর ভূমিকার সত্যিই বিকল্প নেই।’
শামীমদের স্বপ্নগুলো ধাক্কা খেয়ে যায় একটি জায়গা—পেশাদারিত্ব। এ জায়গাটাতেই আমরা পিছিয়ে যাই সব সময়। যেকোনো কিছুতেই।