চীন আরেকটি বৈশ্বিক উদ্যোগে বাংলাদেশকে পাশে চায়

0
151
চীনের ভাইস মিনিস্টার সুন ওয়েইডং

প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগেও (গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ—জিডিআই) বাংলাদেশকে যুক্ত করতে চায় চীন। স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবিলা, সংযুক্তির জন্য যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন, ডিজিটাল অর্থনীতিসহ আটটি ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দিয়ে জিডিআইয়ে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে শিগগিরই সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করতে চায় দেশটি।

জিডিআইয়ে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি আজ শনিবার ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ ও চীনের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকের আলোচনায় গুরুত্ব পাবে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে চীনের ভাইস মিনিস্টার সুন ওয়েইডং গতকাল শুক্রবার রাতে ঢাকায় এসেছেন। আজ সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক শুরু হবে। এতে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন।

চীনের প্রস্তাবে ক্ষতিকর কিছু নেই। এখানে কোনো দেশকে রুখে দেওয়ার কোনো উপাদান নেই। মূলত জিডিআইতে উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ

উল্লেখ্য, চীনের আরেকটি বৈশ্বিক উদ্যোগে (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই) যুক্ত হতে সাড়ে ছয় বছর আগে সমঝোতা স্মারক সই করেছিল বাংলাদেশ। বিআরআইয়ের পর ২০২১ সাল থেকে জিডিআইকে সামনে এনেছে চীন। বিআরআই মূলত যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সংযুক্তির উদ্যোগ। আর জিডিআই হচ্ছে মূলত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ডিজিটাল অর্থনীতিকে ঘিরে উন্নয়ন সহযোগিতার উদ্যোগ।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ বা জিডিআইয়ে বাংলাদেশকে যুক্ত করতে বেইজিং চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশকে সমঝোতা স্মারকের খসড়া পাঠায়। ‘উন্নয়ন সহযোগিতা জোরদার এবং বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের বিকাশ’ শীর্ষক ওই সমঝোতার খসড়া নিয়ে গত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ঢাকায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা আন্তমন্ত্রণালয় সভা করেন। ওই সভায় সমঝোতা স্মারক সইয়ের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। চীনের প্রস্তাবিত সমঝোতা স্মারকের বাংলাদেশের মতামত যুক্ত করে তা দেশটির কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবিত ওই খসড়া অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হলে এর মেয়াদ হবে দুই বছর।

বাংলাদেশ জিডিআইতে যুক্ত হলে এর ভূরাজনৈতিক প্রভাবসহ রাজনৈতিক দিকও বিবেচনা করা উচিত। তাই এখনই সমঝোতা স্মারক সই না করে আরও কিছুটা সময় নেওয়া উচিত, আন্তমন্ত্রণালয় সভায় এমন মত দেওয়া হয়েছে।

আন্তমন্ত্রণালয় সভার বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, জিডিআই নিয়ে চীনের সঙ্গে সমঝোতা সইয়ের পক্ষে মত এসেছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে চীনের প্রস্তাবিত সমঝোতা স্মারক সই করার পক্ষে মত এসেছে। তবে বৈঠকে এমন মতও এসেছে যে একমাত্র উন্নয়নকে বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের একটি বৈশ্বিক উদ্যোগে যুক্ত হলে বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে কতটা লাভবান হবে, সেটি আরও ভালোভাবে মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ জিডিআইতে যুক্ত হলে এর ভূরাজনৈতিক প্রভাবসহ রাজনৈতিক দিকও বিবেচনা করা উচিত। তাই এখনই সমঝোতা স্মারক সই না করে আরও কিছুটা সময় নেওয়া উচিত, আন্তমন্ত্রণালয় সভায় এমন মত দেওয়া হয়েছে।

গত বছরের আগস্টে ঢাকা সফরের সময় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে জিডিআইয়ে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ করেন। তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, চীনের অনুরোধ বিবেচনা করে দেখা হবে।

ওয়াং ইর অনুরোধের সপ্তাহ দুয়েক পর এ বিষয়ে বাংলাদেশের কাছে একটি কূটনৈতিক চিঠি পাঠায় বেইজিং। জিডিআই বাস্তবায়নে অংশীদারদের নিয়ে চীন এ পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, চিঠিতে তা উল্লেখ করা হয়। মূলত স্বাস্থ্য, খাদ্য ও জ্বালানি সুরক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির বিকাশ, দক্ষতা উন্নয়ন, সুনীল অর্থনীতি ও বনায়নের ক্ষেত্রে চীন যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা বাংলাদেশকে জানানো হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চীনকে জানানো হয়, বেইজিং এ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে কী করতে চায়, সেটা জানানো উচিত। এরই ধারাবাহিকতায় চীন বাংলাদেশের কাছে জিডিআই সমঝোতার খসড়া পাঠায়।

অনেকটা কাকতালীয় ঘটনা হলেও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, এ বছর চীনের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের তিনটি সফরের সঙ্গে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের কোনো না কোনো যোগসূত্র আছে। বিশেষ করে গত জানুয়ারিতে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফরের ঠিক আগে ঢাকায় যাত্রাবিরতি করেছিলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং। কয়েক ঘণ্টার ওই যাত্রাবিরতির সময় তিনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেন।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ওয়াশিংটন আর বেইজিংয়ের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে কোনো অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হলে এর সুযোগ নিতে চেষ্টা করবে চীন।

এরপর গত মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ওয়াশিংটন যাওয়ার এক দিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন মিয়ানমারবিষয়ক চীনের বিশেষ দূত দেং সিজুন। ওই সময় তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে আলোচনা করেন। চীনের বিশেষ দূতের ওই সফরের ধারাবাহিকতায় পরে এপ্রিলের দ্বিতীয়ার্ধে পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু নিয়ে চীন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করেছিল।

এবার চীনের ভাইস মিনিস্টার সুন ওয়েইডং এমন একটা সময়ে ঢাকায় আসছেন, যখন সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনিতেই নির্বাচন ও মানবাধিকার সুরক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একধরনের টানাপোড়েন দৃশ্যমান।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ওয়াশিংটন আর বেইজিংয়ের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে কোনো অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হলে এর সুযোগ নিতে চেষ্টা করবে চীন।

উল্লেখ্য, জাতীয় নির্বাচনের আগে আগামী সেপ্টেম্বরে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ভারত সফরের কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ওই সময়ের আগে বা পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বেইজিং সফরে নেওয়ার ব্যাপারে চীনের আগ্রহের কথা কূটনৈতিক পর্যায়ে শোনা যাচ্ছে।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগের ঘোষণা দেন। তিনি বলেছিলেন, করোনা মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, সমন্বিত ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের ধারা নিশ্চিত করতে হলে বিশ্বকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের জন্যও জিডিআই গ্রহণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ এসডিজিতে যুক্ত আছে। তাই নতুন করে একই ধরনের প্রক্রিয়ায় গিয়ে কতটা লাভ হবে, সেটা আরও গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার, এমন আলোচনা কূটনীতিকদের মধ্যে রয়েছে।

ভারত এবং প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে চীনের অঞ্চল ও পথের উদ্যোগে (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ—বিআরআই) যুক্ত হতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে সমঝোতা সই করে বাংলাদেশ। আর গত মাসে ভারত মহাসাগরীয় দৃষ্টিভঙ্গি (আইপিও) প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।

এখানে বলে রাখা ভালো, বিআরআইয়ের পর জিডিআইকে উন্নয়নের প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে চীন। এই উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশসহ এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের বন্ধুদেশগুলোকে চীন আরও কাছে নিতে চায়। মূলত বন্ধুদেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করতে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।

বেইজিংয়ে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ মনে করেন, জিডিআই নিয়ে সমঝোতা স্মারকটি সই করা উচিত। গতকাল বিকেলে তিনি বলেন, চীনের প্রস্তাবে ক্ষতিকর কিছু নেই। এখানে কোনো দেশকে রুখে দেওয়ার কোনো উপাদান নেই। মূলত জিডিআইতে উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এমনিতেই চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। এই ধারাবাহিকতায় চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করতে একটি বার্তা দেওয়া জরুরি। জিডিআইয়ে অন্তর্ভুক্তির জন্য সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) সই করে সেই বার্তা দিতে পারে বাংলাদেশ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.