চীনকে জবাব দিতে ভারতের ত্রিমুখী পরিকল্পনা

0
160
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে আজ চীন বিরোধী বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স

লাদাখে অপ্রত্যাশিত আঘাতের পর ভারত সতর্ক হচ্ছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর স্পর্শকাতর এলাকাগুলোয় অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েনের পাশাপাশি বিমানবাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিও বাড়ানো হয়েছে। বিমানবাহিনীর প্রধান আর কে এস ভাদুরিয়া গত বুধ ও বৃহস্পতিবার লাদাখ ও শ্রীনগর সফর করেছেন।

এর পরেই সীমান্তবর্তী এলাকায় বাড়ানো হয়েছে সুখোই-৩০, মিরাজ-২০০০ যুদ্ধবিমান এবং অ্যাপাশে ও চিনুক হেলিকপ্টারের উপস্থিতি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে একাধিক সরকারি সূত্র এই খবর নিশ্চিত করেছে।

লাদাখের গলওয়ানে ১৫ থেকে ১৬ জুনের ওই সংঘর্ষের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে এসেছে। শুধু ২০ জন ভারতীয় জওয়ানের মৃত্যুই হয়নি, চীন ১০ জন ভারতীয় সেনাকেও আটক করেছিল। সামরিক পর্যায়ে দুই দফা আলোচনার পর বৃহস্পতিবার বিকেলে চীন তাদের মুক্তি দেয়। সেনাসদস্যদের অপহরণের বিষয়টি ভারতীয় সেনাবাহিনী কিন্তু কখনো স্বীকার করেনি।

গলওয়ানের সংঘর্ষের পর জওয়ানদের এই অপহরণের খবর সেনা সূত্রেই জানাজানি হয়। কিন্তু ভারত সরকার বা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তা স্বীকার করা হয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতেও বিষয়টি ঊহ্য ছিল। রাতে সেনাবাহিনী যে বিবৃতি প্রচার করে, তাতে বলা হয়, ভারতীয় বাহিনীর সবারই হদিস মিলেছে। কেউ নিখোঁজ নেই। অথচ সত্য হলো, সংঘর্ষ চলাকালীন চীনা সেনারা চারজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা ও ছয়জন জওয়ানকে আটক করে রেখেছিল। পিটিআইসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম শুক্রবার সেই খবর দেয়।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ানও ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিবৃতির পর জানান, ‘যত দূর জানি আমাদের কাছে ভারতের আর কোনো সেনা আটক নেই।’

ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ আজও এই বিষয়ে নীরব। যদিও তারা জানিয়েছে, আহত জওয়ানরা সবাই বিপদমুক্ত। গুরুতর আহতদের ১৮ জন এখনো চিকিৎসাধীন। অল্প জখম ৫৮ জন এক সপ্তাহের মধ্যেই কাজে যোগ দিতে পারবেন।

গলওয়ানপর্বের পর ভারতের কৌশল এখন ত্রিমুখী। প্রথমত, সামরিক ও কূটনৈতিক স্তরে আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত, কূটনৈতিক পর্যায়ে বৈশ্বিক জনমত ভারতের পক্ষে এবং চীনের বিপক্ষে নিয়ে যাওয়া। তৃতীয়ত, ভারতীয় অর্থনীতির অতিরিক্ত চীন-নির্ভরতা কমানো।

করোনাক্রান্ত ভারতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে চীনা পণ্য বয়কটের প্রসঙ্গ। গলওয়ানকাণ্ডের পর এই স্লোগান নতুন মাত্রা পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে চীনা পণ্য বয়কট নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। ভারত সরকার ও সরকারি কিছু সংস্থার সিদ্ধান্ত সেই আন্দোলনে বাতাস দিচ্ছে। যেমন, টেলিকম–শিল্প। রাষ্ট্রায়ত্ত দুই সংস্থা বিএসএনএল ও এমটিএনএলকে কেন্দ্রীয় সরকার চীনা সংস্থার তৈরি যন্ত্রাংশ ব্যবহার না করার নির্দেশ দিয়েছে। রেলের সিগন্যালিং ব্যবস্থা তৈরির একটি বরাত দেওয়া হয়েছিল এক চীনা সংস্থাকে। প্রায় ৫০০ কোটি রুপির সেই প্রকল্প ‘শ্লথগতির’ কারণ দেখিয়ে ওই সংস্থার হাত থেকে রেল কর্তৃপক্ষ নিয়ে নিয়েছে। কনফেডারেশন অব অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স (সিএআইটি) চীনা পণ্য বয়কটের জন্য দেশজোড়া প্রচার অভিযান শুরু করেছে।

‘ভারতীয় সম্মান, হামারা অভিমান’ নামে ওই প্রচারসূচি রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এরই পাশাপাশি ওই সংগঠন অমিতাভ বচ্চন, আমির খান, অক্ষয় কুমার, দীপিকা পাড়ুকোন, ক্যাটরিনা কাইফ, শচীন টেন্ডুলকার, মহেন্দ্র সিং ধোনি, বিরাট কোহলিদের মতো পরিচিতদের বলেছে, তাঁরা যেন চীনা পণ্যের বিজ্ঞাপনে অংশ না নেন। কোনো পণ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর না হন। ভারতীয় মোবাইল বাজারের প্রায় ৮০ শতাংশ ওপো, ভিভো, শিয়াওমিদের মতো চারটি চীনা সংস্থার দখলে। এসব মোবাইল না কেনার আন্দোলনও শুরু হয়েছে। এর জেরে ওপো ইউটিউবে তাদের ৫জি স্মার্টফোন বাজারে আনার প্রচার সাময়িক স্থগিত রেখেছে। ৫জি তরঙ্গ ট্রায়ালে চীনা সংস্থা হুয়াউইকে না ডাকার দাবিও ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। আপাতত সর্বত্র আলোচনা, চীনা পণ্য বয়কট আন্দোলন ভারতীয় অর্থনীতির কতটা ক্ষতি করবে ও উপযুক্ত প্রস্তুতি না নিয়ে বয়কটের সিদ্ধান্ত হঠকারী প্রতিপন্ন হবে কি না, তা নিয়ে। এরই পাশাপাশি গোয়েন্দাদের একটি সতর্কবার্তাও জানাজানি হয়েছে। গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৫২টি চীনা অ্যাপ দেশের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার পক্ষে যথেষ্ট বিপজ্জনক।

চীন থেকে ভারতের বার্ষিক আমদানির পরিমাণ এই মুহূর্তে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি রুপি। বাণিজ্যিক ঘাটতির পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। সিএআইটি চায় আগামী এক বছরের মধ্যে চীনা আমদানি অন্তত এক লাখ কোটি রুপি কমিয়ে ফেলতে। নিতিন গড়কড়ি, রামবিলাস পাসোয়ানদের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পাশাপাশি রাম মাধবের মতো বিজেপির নেতা দেশের স্বাভিমান জাগিয়ে চীনা পণ্য বর্জনের সরাসরি ডাক দিচ্ছেন। সামাজিক মাধ্যমও এই নিয়ে তোলপাড়।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, নয়াদিল্লি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.