অনিয়মসহ বিভিন্ন কারণে ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট (ভিডব্লিউবি) কার্যক্রমের এবারের চক্রের (সময়) চূড়ান্ত তালিকা থেকে ৫৮ হাজার ২৩৫ নারী বাদ পড়েছেন।
ভিডব্লিউবি কার্যক্রম-সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির ভাষ্য, জনপ্রতিনিধিদের পক্ষপাত, বরাদ্দ কার্ডের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, মাঠপর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংকট, নজরদারির দুর্বলতাসহ বিভিন্ন কারণে নির্ধারিত শর্ত পূরণ না করেও অনেকে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। তালিকায় এখনো এমন নাম থাকতে পারে।
ভিডব্লিউবি কার্যক্রমের কর্মসূচি কর্মকর্তা আয়েশা আক্তার গত সোমবার বলেন, ‘অনিয়ম শনাক্ত হওয়ামাত্র আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভিডব্লিউবি কার্যক্রমটি মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। কার্যক্রমটির আগের নাম ছিল দুস্থ মহিলা উন্নয়ন (ভিজিডি)। ভিডব্লিউভি কার্যক্রমের তালিকাভুক্ত দরিদ্র নারীরা দুই বছর ধরে মাসে ৩০ কেজি চাল সহায়তা পান।
অনিয়ম-অসংগতির কারণে চূড়ান্ত তালিকা থেকে যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের জায়গায় যোগ্য অন্য নারীদের নাম যুক্ত করা হয়েছে। অনিয়ম ধরা পড়লেই তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হবে।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, এবার ভিডব্লিউবি চক্র ২০২৩-২৪-এর জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১০ লাখ ৪০ হাজার কার্ড। এই চক্রে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তালিকাভুক্ত নারীরা সহায়তা পাবেন। এবারের চক্রে তালিকাভুক্ত হতে আবেদন জমা পড়ে ২৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৩৭টি। আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে বরাদ্দ কার্ড অনুযায়ী, ১০ লাখ ৪০ হাজার নারীর চূড়ান্ত তালিকা করা হয়। এখন এই তালিকা থেকে বাদ পড়লেন ৫৮ হাজারের বেশি নারী।
যে কারণে নাম বেশি বাদ
ভিডব্লিউবি কার্যক্রমের জন্য আবেদন করা নারীরা অন্য খাদ্য কর্মসূচিতে আছেন কি না বা তাঁরা আবেদনের জন্য নির্ধারিত শর্ত পূরণ করেছেন কি না, তা যাচাই-বাছাইয়ের লক্ষ্যে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) সমন্বয়ের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) রয়েছে।
এমআইএসের তথ্য অনুসারে, সরকারের অন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে থাকার পরও ভিডব্লিউবি কার্যক্রমের জন্য আবেদন করে অনেক নারী তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এমন ৩৮ হাজার ৫৮৭ জন নারীকে শনাক্ত করে চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ কারণেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নারী তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন।
এমআইএসে তথ্যের অসংগতি শনাক্তের জেরে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন ১২ হাজার ৬৩২ নারী। তথ্যের অসংগতি-সংক্রান্ত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে আর্থিকভাবে সচ্ছল; এবারের তালিকায় ছিলেন, এমন কেউ আগের দুই বছরের চক্রেও ছিলেন; একই ধরনের অন্য সামাজিক কর্মসূচিতে আছেন; তালিকাভুক্ত হয়ে অর্থের বিনিময়ে অন্যের কাছে কার্ড হস্তান্তর; তালিকাভুক্ত নারীর মৃত্যুসহ অন্যান্য কারণ।
এ ছাড়া এমআইএসে একই নাম দুইবার তালিকাভুক্ত হয়েছে—এমন নারীরা শনাক্তের পর তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। আবার কেউ স্মার্ট কার্ড ও পুরোনো জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিন্ন নম্বর ব্যবহার করে দুইবার তালিকাভুক্ত হয়ে ধরা পড়ার পর বাদ পড়েন। এ কারণে বাদ পড়েছেন ৭ হাজার ১৬ জন নারী।
অনিয়ম-অসংগতি থেকে যাওয়ার কারণ
এসব অনিয়ম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মাধ্যমে ধরা পড়ার কথা। কারণ, এলাকার তথ্য তাঁরা ভালোভাবেই জানেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা ইচ্ছেমতো নাম তালিকাভুক্ত করেন বলে স্বচ্ছতা বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার ২ নম্বর ভেড়ভেড়ী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোজাহারুল ইসলাম সম্প্রতি বলেন, তিনি নিজে তাঁর ওয়ার্ডের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রেখে তালিকার জন্য নাম দিয়েছেন। এই ইউনিয়নে ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্যসহ মোট ১২ জন রয়েছেন। অন্য সদস্যরা তাঁদের ওয়ার্ডের ক্ষেত্রে নিয়ম বজায় রেখেছেন কি না, তা নিয়ে মন্তব্য করার এখতিয়ার তাঁর নেই।
উপজেলা ইউপি সদস্য ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোজাহারুল জানান, তাঁর ইউনিয়ন থেকে এবার মোট ৪২৩ জন নারী তালিকাভুক্ত হয়েছেন। তবে কার্ডের জন্য চাহিদা রয়েছে অনেক বেশি।
ধরা পড়লেই নাম বাদ যাবে
গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলায় ৯টি ইউনিয়ন রয়েছে। ৯ ইউনিয়নের ভিডব্লিউবি কার্যক্রমে তালিকাভুক্তি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। চলতি বছরের ৯ মে এসব অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর।
এর মধ্যে ৮টি ইউনিয়নের তদন্ত প্রতিবেদনে ৭৫টি নামের ক্ষেত্রে অনিয়ম পাওয়া যায়। অপর ইউনিয়নের (মনোহরপুর) তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি। এই উপজেলার জন্য মোট কার্ড বরাদ্দ রয়েছে ২ হাজার ৩৪৩টি।
ভিডব্লিউবি কার্যক্রমের কর্মসূচি কর্মকর্তা আয়েশা আক্তার বলেন, অনিয়ম-অসংগতির কারণে চূড়ান্ত তালিকা থেকে যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের জায়গায় যোগ্য অন্য নারীদের নাম যুক্ত করা হয়েছে। অনিয়ম ধরা পড়লেই তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হবে।