চীন, রাশিয়ার ঋণ পরিশোধ চাপ বাড়াচ্ছে। গত অর্থবছরে প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড়—দুটোই কমেছে।
বিদেশি ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়ছে। সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরেই আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৭ শতাংশের বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। আর গত ছয় বছরের হিসাব ধরলে পরিশোধের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রাথমিক হিসাবে জানা গেছে, বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২৭৪ কোটি ডলার ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২০১ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ৭৩ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ বেড়েছে।
সম্প্রতি তৈরি করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩২৮ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। ছয় বছর পর (২০২৯-৩০ অর্থবছর) তা বেড়ে দাঁড়াবে ৫১৫ কোটি ডলার। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ যদি আরও কোনো ঋণ না-ও নেয়, তবু ২০৬২ সাল পর্যন্ত ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হবে।
অর্থনৈতিক সংকটে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রায় আয় অনেক কমে গেছে। সে তুলনায় ব্যয় বেড়েছে। এতে সরকারের চলতি ও আর্থিক হিসাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। রপ্তানি পরিস্থিতি ভালো হলেও প্রবাসী আয়ে ওঠানামা রয়েছে। ডলারে নেওয়া বেসরকারি খাতে ঋণের বড় অংশই আর নবায়ন হচ্ছে না। আর এমন এক সময়ে সরকারের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে গিয়েও ডলার খরচ বেশি হচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ প্রায় অর্ধেক কমে গেছে।
কেন চাপ বাড়ছে
সহজ শর্তের ঋণের ছাড় কম হওয়া এবং বেশি সুদের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধির কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেশি বাড়ছে। পাশাপাশি আছে চীন ও ভারত থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের চাপ।
ইআরডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে আন্তর্জাতিক সুইফট সিস্টেম থেকে বাদ দেওয়ায় রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের কিস্তির অর্থ রাশিয়ায় পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষায়িত হিসাবে তা রাখা হচ্ছে। এ পর্যন্ত গত এক বছরে ৩৩ কোটি ডলার রাখা হয়েছে, যা ঋণ পরিশোধ হিসাবে দেখানো হচ্ছে।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১১০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। পরের ১০ বছরে অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে ২০১ কোটি ডলারের উন্নীত হয়। মূলত চীনের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় গত দু-তিন বছর ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার ঋণ। আর এই চাপ সামনে আরও বাড়বে। কেননা, চলতি অর্থবছরেই চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প ও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘ঋণ পরিশোধের অঙ্ক দেখে মনে হচ্ছে, চাপ বাড়ছে। কিন্তু এখনো আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে আছে। ঋণ পরিশোধে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, আমরা বিদেশিদের কাছ থেকে যে ঋণ নিচ্ছি, তা প্রবৃদ্ধিতে যুক্ত হচ্ছে। উৎপাদন বাড়ছে।’
বিদেশি সহায়তা কমার কারণ হিসেবে শামসুল আলম মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব পরিস্থিতিতে বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতায় প্রভাব পড়তে পারে। বিদেশি ঋণপ্রবাহ সব সময় সরল গতিতে চলে না, ওঠানামা করবে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় আগের চেয়ে বেড়েছে। ডলার-সংকট কাটছে, তাই ঋণ পরিশোধে সমস্যা হবে না।
৫ বছরের মধ্যে কম প্রতিশ্রুতি
প্রতিবছর বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান, চীন, ভারতসহ উন্নয়ন সহযোগীরা নতুন নতুন ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। আবার আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতির ঋণের অর্থ ছাড়ও করে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান, চীন, ভারতসহ উন্নয়ন সহযোগীরা সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে আগের পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরের মাত্র ৮৮০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১৩৭ কোটি ডলার কম।
গত পাঁচ বছরের দাতাদের প্রতিশ্রুতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯৯০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি মিলেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৭ কোটি ডলার।
ছাড় কমেছে ১৭০ কোটি ডলার
২০২১-২২ অর্থবছরটি ছিল বিদেশি সহায়তা পাওয়ার একটি বড় সাফল্যের বছর। ওই বছর রেকর্ড ১ হাজার ৯৭ কোটি ডলার বিদেশি সহায়তা ছাড় হয়। এর আগে কখনো এক বছরে বিদেশি সহায়তার ছাড় ১ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়নি।
কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে অনেকটা এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়। এক লাফে বিদেশি সহায়তার অর্থ ছাড় ১৭০ কোটি ডলার কমে যায়। গত অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীরা সব মিলিয়ে ৯২৭ কোটি ডলার দিয়েছে। এক অর্থবছরে বিদেশি সহায়তা ছাড় ও প্রতিশ্রুতি কমার ঘটনা আর ঘটেনি বলে ইআরডি সূত্রে জানা গেছে। এ নিয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইআরডির সমন্বয় সভায় প্রশ্ন তোলেন কয়েকজন ইআরডি কর্মকর্তা।
পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৬৫৪ কোটি ডলার বিদেশি সহায়তা ছাড় হয়। পরের চার বছরে তা হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার পৌঁছে যায়।
ইআরডির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উন্নয়ন সহযোগীরা সবাই সতর্ক হয়ে গেছে। বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলো একধরনের চাপে আছে এবং সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত। এ ছাড়া দেশের অর্থনীতিও চাপে থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নেও ধীরগতি আছে। এসব কারণে বিদেশি সহায়তার ছাড় ও প্রতিশ্রুতি কমেছে।
পাইপলাইনে ৪৫ হাজার কোটি টাকা
বাংলাদেশের জন্য পাইপলাইনে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি ডলার আছে। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি সহজ শর্তের ঋণ। এই অর্থ বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ আছে। শুধু চাই অর্থছাড়ের জন্য প্রকল্প।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি নমনীয় শর্তের ঋণ নিয়েছে। বর্তমানে এই ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। বিশ্বব্যাংকের মতো সহজ শর্তের ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ৩২ থেকে ৪০ বছর।
অন্যদিকে গত ১০ বছরে চীন, ভারত ও রাশিয়ার কাছ থেকে ৩ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে আছে চীনের ১ হাজার ৭৫৪ কোটি ডলার, রাশিয়ার ১ হাজার ১৮৭ কোটি ডলার এবং ভারতের ৭৩৬ কোটি ডলার। এসব ঋণ পরিশোধের সময়সীমা গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০-২৫ বছর। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্যান্য সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে ঋণ নিলে যত বছরে পরিশোধ করতে হবে; রাশিয়া, চীন ও ভারতের ঋণ পরিশোধের সময় এর প্রায় অর্ধেক। এ কারণে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
সামগ্রিক বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঋণ পরিশোধের চাপ তো মাত্র শুরু হলো। গত অর্থবছরে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। কারণ, রাশিয়া, চীন ও ভারতের কাছ থেকে নেওয়া কঠিন শর্তের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। আগামী ১৫-২০ বছরের মধ্যে এসব ঋণ শোধ করতে হবে।
আহসান এইচ মনসুরের মতে, কঠিন শর্তের এসব ঋণের বেশ কিছু প্রকল্প অর্থনৈতিক বিবেচনায় লাভজনক নয়। যেমন চীনের অর্থায়নে ৬২ হাজার কোটি টাকা খরচ করে একাধিক পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। রাজধানী থেকে দিনে ৪-৫টির বেশি ট্রেন চলবে না। তাহলে কত বছরে এই টাকা উঠে আসবে। আবার এত টাকা খরচ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এসব প্রকল্পে যত রাজস্ব আদায় হবে, তা দিয়ে ঋণ পরিশোধ কঠিন হবে।