জনবলকাঠামোয় অনুমোদিত পদের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে। এরপরও অস্থায়ী ভিত্তিতে একের পর এক কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে সংস্থাটি। কিন্তু এ জন্য দেওয়া হচ্ছে না কোনো বিজ্ঞপ্তি।
গত পৌনে ২ বছরে ১৩০ জনের বেশি কর্মী চাকরি পেয়েছেন সিটি করপোরেশনে। এর মধ্যে ৩ অক্টোবর এক দিনেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অন্তত ৩০ জনকে।
বিজ্ঞপ্তি ছাড়া লোক নিয়োগের ঘটনাকে ‘মারাত্মক অনিয়ম’ বলে মন্তব্য করেছেন সরকারি চাকরির বিধিবিধানের বিশেষজ্ঞরা। আগের অস্থায়ী লোকদের স্থায়ীকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করে আরও কর্মী নিয়োগ দেওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে বর্তমান কর্মীদের মধ্যে। শ্রমিকনেতাদের দাবি, লোকবল নিয়োগ দিতে হলে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার দরকার ছিল।
তবে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, সিটি করপোরেশনের সেবা কার্যক্রম বজায় রাখার স্বার্থে জরুরি প্রয়োজনে লোক নিয়োগ দিতে হচ্ছে।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ‘কাজ নেই, মজুরি নেই’ ভিত্তিতে লোক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব নিয়োগের নেপথ্যে আছেন সিটি করপোরেশনের প্রভাবশালী এক কর্মকর্তা, শ্রমিকনেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। চাকরি পাওয়া ব্যক্তিদের কীভাবে যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তার সঠিক কোনো সদুত্তর নেই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের কাছে।
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ অনুযায়ী, জরুরি প্রয়োজনে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ দিতে পারবে সিটি করপোরেশন। তবে এ জন্য সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু বর্তমানে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা।
বর্তমান মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর আমলে অস্থায়ী ভিত্তিতে লোক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া না হলেও আগের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সময় বিজ্ঞপ্তির পাশাপাশি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া হতো। বিশেষ করে ডোর টু ডোর প্রকল্পের আওতায় দুই হাজার লোক দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিয়েছিল সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছিল। তবে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াও তাঁর আমলে লোক নিয়োগের ঘটনা ঘটেছিল।
পদ রয়েছে ৪ হাজার ২২৬, কর্মরত ৮ হাজার ২৪৫
সিটি করপোরেশনের নথিপত্র ও বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিদ্যমান জনবলকাঠামো অনুযায়ী মোট পদ রয়েছে ৪ হাজার ২২৬টি। এসব পদের বিপরীতে কর্মরত ৮ হাজার ২৪৫ জন, অর্থাৎ মূল পদের তুলনায় বাড়তি লোকবল আছে ৪ হাজার ১৯ জন।
সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারির নির্বাচনে মেয়র পদে জয়ী হয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি মেয়রের দায়িত্ব নেন। শুরুতে অবশ্য লোক নিয়োগের তেমন ঘটনা ঘটেনি। তবে দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পর থেকে অস্থায়ী ভিত্তিতে লোক নিয়োগ শুরু হয়। এরপর তা বেড়েই চলছে।
সিটি করপোরেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে লোক নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই চতুর্থ শ্রেণির পদগুলোয় লোক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে শ্রমিক, কর আদায়কারী, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, সড়ক তদারককারী, সুপারভাইজার, অফিস সহকারী, সড়ক পরিদর্শক পদে গত পৌনে ২ বছরে অন্তত ১৩০ জন নিয়োগ পেয়েছেন। এসব কর্মীর সিটি করপোরেশনের সংস্থাপন, প্রকৌশল, রাজস্ব ও শিক্ষা বিভাগের অধীন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের দৈনিক মজুরি ৪৫২ টাকা। তবে যেদিন কাজ করবেন না, ওই দিন কোনো মজুরি দেওয়া হবে না।
অস্থায়ী ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে সিটি করপোরেশন শ্রমিক লীগের সভাপতি ফরিদ আহমদ বলেন, এখনো তাঁদের অনেক অস্থায়ী কর্মীকে স্থায়ী করা হয়নি। শ্রমিক নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া দরকার ছিল।
নিয়োগ পাওয়াদের আদেশপত্রে যা আছে
সিটি করপোরেশনের নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের নিয়োগ আদেশপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কারও নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্তারোপ করা হয়েছে, আবার কারও ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। আরোপ করা শর্তগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এই আদেশ চাকরি স্থায়ীকরণের নিশ্চয়তা দেবে না। চাকরিকালে কোনো ধরনের অতিরিক্ত ভাতা পাবেন না। নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তি করপোরেশনের আদেশ পালনে বাধ্য থাকবেন। আর কোনো প্রকার কারণ দর্শানো ছাড়া যেকোনো সময় নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে সিটি করপোরেশন। এ জন্য কোনো প্রকার আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন না ওই ব্যক্তি। আর চাকরি ছাড়তে চাইলে ৩০ দিন আগে কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে।
অস্থায়ী কর্মীদের নিয়োগপত্র বা আদেশে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করেছেন সচিব খালেদ মাহমুদ। অস্থায়ী নিয়োগের বিষয়ে ২৫ অক্টোবর দুপুরে খালেদ মাহমুদ প্রথমে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি এই বিষয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেন। অবশ্য পরে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনে অনেক পদ খালি রয়েছে। সিটি করপোরেশনের সেবা ও কাজের পরিধি বেড়েছে। অনেকগুলো প্রকল্প চলছে। লোকবলসংকটের কারণে কাজের ব্যাঘাত ঘটছে। তাই জরুরি প্রয়োজনে লোক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
কর্মী নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সচিব খালেদ মাহমুদ কোনো মন্তব্য করেননি। তবে এক কর্মকর্তা বলেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলে লোক নিতে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে বর্তমানে যাঁরা অস্থায়ী আছেন, তাঁরা মামলা করেন, আন্দোলন করেন। তাই বিজ্ঞপ্তি ছাড়া লোক নেওয়া হচ্ছে।
এই বিষয়ে মন্তব্য জানতে গত বৃহস্পতিবার সিটি করপোরেশনের মেয়রের কার্যালয়ে গেলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানানো হয়। এ ছাড়া মুঠোফোনে যোগাযোগ করে ও খুদে বার্তা দিয়েও মেয়রের মতামত পাওয়া যায়নি।
‘মারাত্মক অনিয়ম’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে এই ধরনের নিয়োগকে ‘মারাত্মক’ অনিয়ম বলে মন্তব্য করেছেন সরকারি চাকরির বিধিবিধানের বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া। তিনি বলেন, এই ধরনের নিয়োগ মারাত্মক অনিয়ম ও বিধিবহির্ভূত। এর মাধ্যমে স্বজনপ্রীতি হয়। নিজেদের পছন্দ ও ঘনিষ্ঠ লোকজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর সিটি করপোরেশন পরিচালিত হয় জনগণের টাকায়। জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞপ্তি ছাড়া নিয়োগ মানেই হচ্ছে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করা। কেননা, মানুষ এখানে চাকরির জন্য আবেদন করার সুযোগ পাচ্ছেন না। এই ধরনের নিয়োগ বন্ধে অবশ্যই দুদককে নজর দিতে হবে।