চট্টগ্রাম বন্দরে ডেনমার্কের মার্সকের বিনিয়োগে সাড়া সরকারের

0
197
চট্টগ্রাম বন্দর

বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ শিপিং কোম্পানি ডেনমার্কের এপি-মুলার মার্সকের বিনিয়োগের আগ্রহে সাড়া দিয়েছে সরকার। চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়ার চরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনায় বিনিয়োগের জন্য গত এপ্রিলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল কোম্পানিটি। গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে পতেঙ্গার লালদিয়ার চরে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা করতে চায়।

মার্সক গ্রুপের বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়েই আগামীকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সভা হওয়ার কথা রয়েছে। এ সভায় গ্রুপটির চেয়ারম্যান রবার্ট মার্সক উগলার অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।

মার্সক গ্রুপ অবশ্য দুই বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের নবনির্মিত পতেঙ্গা টার্মিনালে বিনিয়োগ ও পরিচালনার জন্য চেষ্টা করে আসছিল। সে সময় এইচঅ্যান্ডএম, মার্সক অ্যান্ড স্পেন্সারের মতো ইউরোপের পোশাকের ক্রেতারাও মার্সকের বিনিয়োগে সমর্থন দিয়েছিল। তবে পতেঙ্গা টার্মিনালটি সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালকে দিয়ে পরিচালনার জন্য সরকার অঙ্গীকার করায় গুরুত্ব পায়নি মার্সকের বিনিয়োগ। পতেঙ্গা না পেয়ে এখন লালদিয়ার চরে টার্মিনাল নির্মাণ-পরিচালনায় আগ্রহ তাদের।

চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বিদেশি বিনিয়োগের বিষয় তুলে ধরে বলেন, লালদিয়ায় টার্মিনাল নির্মাণে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে ডেনমার্ক। সব মিলিয়ে আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরে বন্দরকেন্দ্রিক ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হতে পারে বলে তিনি জানান। বন্দরকেন্দ্রিক বিনিয়োগ দিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত শক্তিশালী করা যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশে চার দশক ধরে ব্যবসা করে আসছে মার্সক গ্রুপ। চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালের ২৫ জুলাই মার্সক বাংলাদেশ লিমিটেড নামে লাইসেন্স নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে গ্রুপটি। শুরুতে বাংলাদেশের এম গাজীউল হকের নামে একটি শেয়ার ছিল। এরপর পুরোপুরি বিদেশি কোম্পানি হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে গ্রুপটি। বর্তমানে বাংলাদেশে তারা ২১টি কনটেইনার জাহাজ পরিচালনা করছে। এ ছাড়া কনটেইনার পরিবহন, গুদাম ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিংসহ লজিস্টিকস খাতে ব্যবসা করছে। বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানির কম-বেশি ৩০ শতাংশ কনটেইনার একাই আনা-নেওয়া করছে কোম্পানিটি।

শিপিংবিষয়ক পরামর্শক সংস্থা আলফালাইনারের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে কনটেইনার ও জাহাজ পরিচালনায় বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মার্সক। লয়েডস লিস্টের গত বছরের প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, চার ধাপ এগিয়ে মার্সক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস বিশ্বের বন্দর পরিচালনায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। নতুন নতুন উদ্ভাবন দিয়ে এই কোম্পানি বিশ্বের শিপিং ও লজিস্টিকস খাতে নজর কাড়ছে।

বাংলাদেশে শিপিং ও লজিস্টিকস খাতে ব্যবসা থাকলেও টার্মিনাল পরিচালনার ব্যবসা নেই তাদের। এপিএম টার্মিনালের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৩৭টি দেশে ৬৫টি টার্মিনাল ও বন্দর পরিচালনা করছে তারা। বাংলাদেশে লালদিয়া টার্মিনালের প্রস্তাব চূড়ান্ত হলে ৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হতে পারে তাদের। সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব ও স্বয়ংক্রিয় টার্মিনাল নির্মাণ করতে চায় গ্রুপটি।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ৩ এপ্রিল নৌপরিবহনমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে লালদিয়ার চরে টার্মিনাল নির্মাণে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়ে চিঠি দেয় মার্সক গ্রুপ। সেখানে বিশ্বমানের টার্মিনাল নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সহযোগিতার কথা জানায় তারা।

জানতে চাইলে বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, লালদিয়ায় মার্সক গ্রুপের বিনিয়োগের বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে বন্দরের কাছে মতামত জানতে চেয়েছে। সেখানে গ্রুপটিকে প্রাথমিক সমীক্ষা করার জন্য বন্দর থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ হিসেবে বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বন্দর।

মার্সক গ্রুপ যেখানে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনায় আগ্রহ দেখিয়েছে, সেখানে এক দশক আগে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ২০১৩ সালে লালদিয়ার চরে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন পায়। সে অনুযায়ী সমীক্ষাও হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে টার্মিনাল নির্মাণে ছয়টি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাবনা জমা দেয়। এর মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করা হয়। তবে সে সময় লালদিয়ার চরের একাংশে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হয়নি। এসব বিবেচনায় নতুন করে টার্মিনাল নির্মাণ লাভজনক হবে না বলে বন্দর কর্তৃপক্ষ তা থেকে সরে আসে। তাতে এ প্রকল্প আর এগোয়নি।

এখন মার্সকের বিনিয়োগ কেন্দ্র করে আবার আলোচনায় এসেছে লালদিয়া টার্মিনাল। এর মধ্যে লালদিয়ার চরে অবৈধ দখলও উচ্ছেদ করা হয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ সেখানে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করে সুরক্ষিত করেছে। তাতে লালদিয়ার চরে টার্মিনাল নির্মাণে আগের মতো জটিলতা থাকছে না।

ডেনমার্কের নাসডাক কোপেনহেগেন এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত মার্সক গ্রুপের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্সক গ্রুপ গত বছর ৮ হাজার ১৫০ কোটি ডলার (৮ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা) ব্যবসা করেছে। কর পরিশোধের পর মুনাফা করেছে ২ হাজার ৯৩০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৬২ শতাংশ বেশি।

মার্সকের বিনিয়োগ নিয়ে জানতে চাইলে বিদেশি ক্রেতাদের হাতে পণ্য পরিবহনের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম বলেন, সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় মার্সক গ্রুপের টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য বিনিয়োগ ইতিবাচক। তাদের জাহাজ, কনটেইনার, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিংসহ লজিস্টিকস সেবা রয়েছে। তাতে বিশ্বমানের সেবা দিতে পারবে তারা। এই বিনিয়োগ দেশের আমদানি–রপ্তানি খাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

মাসুদ মিলাদ

চট্টগ্রাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.