চট্টগ্রাম ওয়াসায়ও আবার এমডির দায়িত্বে ৮১ বছর বয়সী এ কে এম ফজলুল্লাহ

0
123
অষ্টমবারের মতো চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে নিয়োগ পেয়েছেন এ কে এম ফজলুল্লাহ, ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফজলুল্লাহর বয়স এখন ৮১ বছর। ১৪ বছর ধরে এ পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। চলতি বছর অক্টোবরে তাঁর সাতবারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় দুই মাস আগে তাঁকে আবার নিয়োগ দিয়েছে সরকার। আজ বৃহস্পতিবার পুনর্নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি সরবরাহ শাখার উপসচিব মুস্তাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৬–এর ২৮ (২) ধারা মোতাবেক এ কে এম ফজলুল্লাহকে তাঁর বর্তমান চাকরির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর থেকে তিন বছরের জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি হিসেবে পুনর্নিয়োগ করা হলো। ১ নভেম্বর থেকে তিন বছর তিনি দায়িত্ব পালন করবেন।

ওয়াসার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা ওয়াসার পথেই হাঁটবে চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ড, এটা সবারই ধারণা ছিল। অর্থাৎ তাকসিম এ খান যেমন আরও একবার ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন, তেমনি এ কে এম ফজলুল্লাহকেই নিয়োগ দেবে সরকার। সেটিই সত্য হলো।

এ কে এম ফজলুল্লাহ আজ সন্ধ্যায় বলেন, ‘অভিজ্ঞতা ও কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে সরকার মনে করেছে, আমাকে দায়িত্ব দিলে প্রকল্পের কাজগুলো ঠিকভাবে শেষ হবে। কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া আমার জানা। তাই দেশের স্বার্থে আমাকে আবার দায়িত্ব দিয়েছে, যদিও আমি হাতে চিঠি পাইনি।’

১৯৪২ সালে জন্ম নেওয়া এ কে এম ফজলুল্লাহ চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে অবসর নেন ২০০০ সালে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ৬ জুলাই প্রথমবার চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে এক বছরের জন্য নিয়োগ পান। এরপর আরও এক বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১১ সালে ঢাকা ওয়াসার আদলে চট্টগ্রাম ওয়াসাতেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ তৈরি করা হয়। ওয়াসা বোর্ডও পুনর্গঠন করা হয়। তখন এমডি পদে নিয়োগ পান তৎকালীন চেয়ারম্যান এ কে এম ফজলুল্লাহ। সেই থেকে এমডি পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

চট্টগ্রাম ওয়াসা পরিচালিত হয় ১৯৯৬ সালের ওয়াসা অ্যাক্ট অনুযায়ী। এ আইনে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এমডি। আইনে এমডি পদে একই ব্যক্তি সর্বোচ্চ কতবার বা কত বছর নিয়োগ পেতে পারেন, সে বিষয়ে কিছু বলা নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এমডি পদে নিয়োগ দেয় সরকার।

এ কে এম ফজলুল্লাহ ওয়াসার আলোচিত কর্মকর্তা। তাঁর আমলে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পাঁচটি বড় প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে কোনো প্রকল্পের কাজই নির্ধারিত মেয়াদে শেষ হয়নি। ব্যয়ও বাড়াতে হয়েছে তিনটির। নগরে পানির সংকটও কাটেনি।

সংকটের মধ্যেও পানির দাম বেড়েছে ১২ বার

বছর পাঁচেক আগে এ কে এম ফজলুল্লাহ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২০২০ সালের মধ্যে চট্টগ্রামবাসী দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা নিরাপদ পানি পাবেন। ওই ঘোষণা আলোর মুখ দেখেনি। এখনো প্রতিদিন ঘাটতি রয়েছে ১২ থেকে ১৫ কোটি লিটার পানির। এ নিয়ে গ্রাহকেরাও ক্ষুব্ধ।

চট্টগ্রাম নগরের পশ্চিম বাঘঘোনার মোহাম্মদ ইউসুফ নামের ষাটোর্ধ্ব গ্রাহক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ২০ বছর আগে তিনি সংযোগ নিয়েছিলেন। এরপর দু-একবার পানি পেয়েছিলেন। এখন আর পানি পান না। তবে বিল (লাইন চার্জ) পরিশোধ করে আসছেন।
অবশ্য শুধু বাঘঘোনা কিংবা মতিঝরনা এলাকায় নয়; নগরের উত্তর কাট্টলি, পাহাড়তলী, দক্ষিণ হালিশহর, দক্ষিণ পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েক লাখ বাসিন্দা পানির অভাবে ধুঁকছেন। কোনো এলাকায় মাসের পর মাস পানি যাচ্ছে না। কোনো এলাকায় সপ্তাহে দুই দিনও পানি থাকছে না।

ওয়াসার বোর্ড সদস্য, কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা বলছেন, সিস্টেম লস বা কারিগরি ত্রুটি ও পানি চুরি কমানো যায়নি। ওয়াসা এখন যা উৎপাদন করে, তার ৩০ ভাগ পানিই গ্রাহকের কাছে পৌঁছায় না। প্রায় ১৪ কোটি লিটার পানি নষ্ট হয়। আর্থিকভাবে বছরে ১৪২ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হয় সংস্থাটিকে।

সংকটের সমাধান না হলেও এ কে এম ফজলুল্লাহর আমলে ১২ বার পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর একলাফে ৩৮ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন তিনি।

এ ব্যাপারে এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে পানির উৎপাদন ছিল মাত্র ১৪ কোটি লিটার। সেই ১৪ কোটিকে তিনি ৫৬ কোটিতে নিয়ে গেছেন। তাঁর সময়ে নতুন নতুন পানি শোধনাগার চালু হয়েছে। তবে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পানির দাম বাড়ানো হয়েছে।

প্রকল্পে ধীরগতি

এ কে এম ফজলুল্লাহ ২০১১ সালে এমডি হওয়ার পর চট্টগ্রাম ওয়াসা পানি সরবরাহে চারটি বড় প্রকল্প নেয়। প্রকল্পগুলো হলো, কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়), কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়), চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প ও ভান্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্প। এ চার প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। কোনোটিই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। দুটিতে ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৭১২ কোটি টাকা।

অন্যদিকে নগরে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে ২০১৮ সাল থেকে ৩ হাজার ৮০৮ কোটি ব্যয়ের একটি প্রকল্পের কাজ করছে ওয়াসা। ৫ বছরে কাজের অগ্রগতি মাত্র ৩০ শতাংশ। ২০২৬ সালের আগে কাজ শেষ হবে না। ব্যয়ও বাড়বে। অবশ্য এ প্রকল্পের কাজ শেষ না হলেও এখন একই ধরনের আরও পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পের ধীরগতির বিষয়ে এমডি বলেন, প্রকল্পের নকশা, অনুমোদন থেকে শুরু করে দরপত্র আহ্বান, জমা ও মূল্যায়ন পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপ পার হতে হয়। এ কারণে প্রকল্পের সময় বেশি লাগে।

তাঁকে নিয়ে নানা সমালোচনা

নিজের বেতন-ভাতা বাড়ানোর আবদার করে এ কে এম ফজলুল্লাহ সমালোচিত হয়েছেন। ওয়াসার নথিপত্র অনুযায়ী, এ কে এম ফজলুল্লাহর মূল বেতন নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, আপ্যায়ন, বিশেষ ভাতাসহ মিলিয়ে মোট পান ৩ লাখ ১৭ হাজার টাকা, যা ২০১৬ সালের মে মাস থেকে কার্যকর হয়।

গত বছরের জানুয়ারিতে তিনি এক লাফে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা বা দেড় শ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির আবেদন করেছিলেন। অর্থাৎ মোট সাড়ে চার লাখ টাকা মূল বেতন চেয়েছিলেন। এ আবেদনের পর বোর্ড সদস্যরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। পরে সমালোচনা মুখে তিনি বেতন বাড়ানোর আবেদন প্রত্যাহার করে নেন।

এ কে এম ফজলুল্লাহকে আবার নিয়োগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সনাক-টিআইবির চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ কে এম ফজলুল্লাহর কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক আছে। এ কে এম ফজলুল্লাহকে যাঁরা নিয়োগ দেন, তাঁদের তিনি সন্তুষ্ট রাখার কাজে পারদর্শী। বোর্ডের সদস্যদেরও তিনি সন্তুষ্ট রাখেন। এ কারণে পানির সংকট দূর করতে না পারা, প্রকল্পের ধীরগতি, ব্যয় বাড়া, পানির মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও কারও কিছু যায় আসে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.