বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম শিকদার ‘গ্রাহকের টাকায়’ ২ হাজার ২০ শতাংশ জমি কিনেছেন। দলিল সূত্রে এসব জমি খুঁজে পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
জমিগুলো কেনা হয়েছে গাজীপুরে। স্থানীয় বাসিন্দা, আলেশার নিয়োগ করা তত্ত্বাবধায়ক ও জমি কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আলেশার কেনা জমির পরিমাণ আরও বেশি। সিআইডি যে পরিমাণ জমির হদিস পেয়েছে, তার দাম দেখানো হয়েছে প্রায় ৩২ কোটি টাকা। অবশ্য তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, দলিলে জমির দাম কম দেখানো হয়েছে। আসলে এই পরিমাণ জমির বাজারমূল্য অন্তত ১৫০ কোটি টাকা।
যেমন এক জায়গায় প্রতি শতাংশ জমির দাম দেখানো হয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার টাকা। যদিও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সেখানে জমির বাজারমূল্য প্রতি শতাংশ সর্বনিম্ন দুই লাখ টাকা।
২০২১ সালের দিকে যখন আলেশা মার্ট গ্রাহককে বড় ছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রির নামে টাকা ওঠাচ্ছিল, তখনই জমিগুলো কেনা হয়। ওই সময় কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। এর একটি এই আলেশা মার্ট। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম শিকদার এখন কারাগারে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মঞ্জুর আলমের বিরুদ্ধে করা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের একটি মামলার তদন্ত করছে। তাদের তদন্তেই আলেশার বিপুল পরিমাণ জমি কেনার তথ্য বেরিয়ে আসে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মনিরুজ্জামান গতকাল শুক্রবার বলেন, আদালতের নির্দেশে মঞ্জুর আলমের ২ হাজার ২০ শতাংশ জমি জব্দ করা হয়েছে।
সিআইডি যে পরিমাণ জমির হদিস পেয়েছে, তার দাম দেখানো হয়েছে প্রায় ৩২ কোটি টাকা। অবশ্য তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, দলিলে জমির দাম কম দেখানো হয়েছে। আসলে এই পরিমাণ জমির বাজারমূল্য অন্তত ১৫০ কোটি টাকা।
কত জমি
মঞ্জুর আলম জমিগুলো কিনেছেন আলেশা হোল্ডিংস লিমিটেডের নামে। সিআইডি ২ হাজার ২০ শতাংশ বা ২০ একর জমির দলিলমূল্য দেখিয়েছে প্রায় ৩২ কোটি টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশি জমি কেনা হয়েছে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মধ্যপাড়া ইউনিয়নের ঠাকুরপাড়া এলাকায়।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুরের মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে ঠাকুরপাড়া সাহেবেরচালা বাজার। গতকাল সকালে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একটি রাস্তার মুখে বড় একটি সাইনবোর্ডে লেখা আলেশা হোল্ডিংস লিমিটেড। সেই রাস্তা ধরে এক কিলোমিটার ভেতরে গিয়ে পাওয়া যায় আলেশার নামে কেনা জমি।
জমিগুলো দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন আলেশার নিয়োগ করা তত্ত্বাবধায়ক নুরুল আলম। তিনি বলেন, তাঁরা দুজন সেখানে কাজ করেন। তবে চার-পাঁচ মাস ধরে মালিকপক্ষ তাঁদের কোনো খোঁজ নেয় না। বেতনও পান না। জমিতে শাকসবজি চাষ করে সেগুলো বিক্রি করে চলেন তাঁরা।
নুরুল আলম আরও বলেন, কালিয়াকৈরের ঠাকুরপাড়া এলাকায় আলেশার জমি সবচেয়ে বেশি। সেখানে একটি মাটির ও একটি পাকা ঘর করা হয়েছে। মঞ্জুর আলম গিয়ে মাঝেমধ্যে পাকা ঘরটিতে থাকতেন। কয়েকটি পুকুর রয়েছে, যা ইজারা দেওয়া।
সিআইডি দুই হাজার শতাংশের মতো জমির খোঁজ পেলেও তত্ত্বাবধায়ক নুরুল আলম বলছেন, সব মিলিয়ে সেখানে আলেশা হোল্ডিংসের নামে জমি রয়েছে ১৩ হাজার ২০০ শতাংশ। এর বাইরে আশপাশে আরও জমি আছে। তিনি শুনেছেন কিছু জমি বিক্রিও করা হয়েছে।
কালিয়াকৈর উপজেলার মাঝুখান এলাকায় দুটি জায়গায় আলেশা হোল্ডিংসের দুটি সাইনবোর্ড দেখা যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সেখানে আলেশার জমি রয়েছে প্রায় ২০০ বিঘা। জমিগুলো নিচু, জলাভূমি। স্থানীয় কিছু যুবক ইজারা নিয়ে তাতে মাছ চাষ করেন।
আলেশাকে জমি কিনে দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কালিয়াকৈর উপজেলার মধ্যপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা তিন থেকে চারজন আলেশার জমি কেনার মধ্যস্থতা করেছেন। তিনি নিজে কিনে দিয়েছেন ২০০ বিঘা জমি। সব জমি আলেশা ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কিনেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ২০২১ সালে একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ জমি কেনা শুরু করা হয়। তারা বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দাম প্রস্তাব করে। কারখানা করার কথাও বলেছিল। এতে মানুষ জমি বিক্রিতে উৎসাহিত হন।
বেশি দাম হাঁকলেও কেউ কেউ জমি বিক্রি করেননি। তাঁদের একজন ঠাকুরপাড়ার নাহিদ স্টোরের মালিক শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আলেশা আমাদের বাড়ির পাশের জমিগুলো ২০২২ সালে কেনে। আমাদের জমি কিনতেও নানাভাবে চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমরা বিক্রি করিনি। তারা আমাদের বাড়ির চলাচলের রাস্তাও বন্ধ করে দিয়েছে।’
ঠাকুরপাড়া এলাকায় আলেশার একটি স্থাপনায় দেখা যায়, বেশ কিছু যন্ত্রপাতি ফেলে রাখা হয়েছে। মোড়ক দেখে বোঝা যায়, সেগুলো চীন থেকে আমদানি করা।
কালিয়াকৈরের মানুষ এখন জানেন, আলেশা মানুষের কাছ থেকে পণ্য বিক্রির কথা বলে টাকা নিয়েছিল। মানুষ তা ফেরত পাচ্ছে না। তাঁরা বিক্রি করা জমিতে কারখানা হওয়ার আশাও করছেন না।
কালিয়াকৈর উপজেলার মধ্যপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ওরা তো বড় বাটপার। শুনেছি মানুষের টাকা মেরে দিয়ে আমাদের এখানে এসে জমি কিনেছে।’
হঠাৎ পরিচিতি, তারপর কারাগারে
আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম ছিলেন একজন স্বল্পপরিচিত ব্যবসায়ী। তবে আলেশা মার্ট খুলে এবং ব্যাপক প্রচার চালিয়ে পরিচিতি পান তিনি। তাঁর আইনজীবীর দাবি, আলেশা হোল্ডিংস নামের একটি প্রতিষ্ঠান ছিল মঞ্জুর আলমের মূল ব্যবসা। সেখান থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্ট খোলেন তিনি।
আলেশা মার্ট খোলার আগে মঞ্জুরের আয় কেমন ছিল, তা সিআইডি তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে। বলা হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের আয়কর বিবরণীতে মঞ্জুর আলম বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন মাত্র ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। তাঁর আয়ের সম্পদের তথ্য সংগতিপূর্ণ নয়।
মানি লন্ডারিং মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আলেশা মার্ট ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসা শুরু করে।
আলেশা মার্ট গ্রাহকদের মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্য বড় ছাড়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা নিত। এভাবে বিপুল টাকা সংগ্রহ করেছিল তারা। ২০২১ সালের দ্বিতীয় ভাগে কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহককে পণ্য অথবা টাকা ফেরত না দেওয়া শুরু করে। তখন পণ্য হাতে পাওয়ার পর টাকা ছাড়ের ব্যবস্থা চালু হয়।
ওদিকে গ্রাহকেরা টাকা না পেয়ে কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ এবং মামলা করা শুরু করেন। এর মধ্যে আলেশা মার্টও ছিল। সিআইডি ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আলেশা মার্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা গ্রাহকের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি।
মঞ্জুর আলম টাকা নিয়ে কী করেছেন, তা অনুসন্ধান করে সিআইডি জানতে পেরেছে, আলেশার চারটি ব্যাংক হিসাব থেকে ৪২১ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যেটা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ। গ্রাহকের টাকায় বিভিন্ন নামে ১০টি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খোলে আলেশা মার্ট।
সিআইডির তথ্য অনুযায়ী, জমির পাশাপাশি মঞ্জুর আলমের নিজের নামে, স্ত্রীর নামে এবং স্বজনদের নামে একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ি পাওয়া গেছে। তিনি ব্যাংকের পরিচালক হতে আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সহসভাপতি আবুল কাশেমকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকের পরিচালক বানানোর কথা বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেন আবুল কাশেম। সিআইডি জানিয়েছে, তিনি মাস দেড়েক আগে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
পুলিশ ও আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মঞ্জুর আলমের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের করা শতাধিক প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ১৩ জানুয়ারি মঞ্জুর আলমকে ঢাকার বনানী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এখন তিনি কারাগারে রয়েছেন। এদিকে গত বৃহস্পতিবার ঢাকার দ্বিতীয় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালত চেক প্রতারণার মামলায় মঞ্জুর আলম ও তাঁর স্ত্রী সাবিয়া চৌধুরীকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন।
মঞ্জুর আলমের আইনজীবী অলিউর রহমান গতকাল বলেন, তাঁরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। তিনি আরও বলেন, মঞ্জুর আলমের বিরুদ্ধে আরও কিছু মামলার বিচার চলছে।
টাকা ফেরত চান গ্রাহকেরা
আলেশা মার্টের কাছে পণ্য কেনার জন্য টাকা দিয়ে বহু গ্রাহক প্রতারিত হয়েছেন। তাঁদের অনেকে মামলা করেছেন, অনেকেই করেননি। কাউকে কাউকে আলেশা মার্ট ব্যাংকের চেক দিয়েছিল, তবে তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে জমানো অর্থ এবং স্বজনদের কাছ থেকে ধার নিয়ে মোটরসাইকেল কেনার জন্য তিন লাখ টাকা আলেশা মার্টকে দিয়েছিলেন মানিকগঞ্জের আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি গত বুধবার বলেন, তিনি এখন একটি বিদ্যালয়ে চাকরি করেন। অল্প বেতন পান। তা থেকেই স্বজনদের টাকা অল্প অল্প করে পরিশোধ করছেন। বাকি টাকা দিয়ে নিজে কোনোরকমে চলেন।
আবদুল্লাহ আল মামুন আলেশার বিরুদ্ধে মামলা করেননি। তিনি আরও বলেন, ‘সবার টাকা সময়মতো দিতে পারিনি। তাই স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। সব সময় মানসিক যন্ত্রণায় থাকি।’
আলেশা মার্টের গ্রাহকদের চাওয়া হলো, সরকার তাদের জমি বিক্রি করে মানুষের টাকা ফিরিয়ে দিক। অবশ্য এভাবে জমি বিক্রি করে টাকা ফেরতের নজির নেই। ২০০৬ সালে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) অনিয়মের বিষয়টি সামনে আসে। তখন সরকার কমিশন গঠন করেছিল, জমি বিক্রি করে মানুষের টাকা ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এখনো তা সম্ভব হয়নি।
২২ হাজার কোটি টাকা
বাংলাদেশে বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) ও ই-কমার্সের নামে গত দেড় যুগে প্রতারণার বড় বড় ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও গ্রাহকদের বরাত দিয়ে বলা হয়, যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকার মতো এমএলএম ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকের পাওনা ২২ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে সাম্প্রতিককালে নতুন নতুন প্রতারণা সামনে আসছে। যার একটি মুঠোফোন অ্যাপে অবৈধ ঋণ বিতরণ। এমএলএম, ই-কমার্স ও অ্যাপভিত্তিক প্রতারণা ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারির সক্ষমতার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের অধ্যাপক সুবর্ণ বড়ুয়া। তিনি বৃহস্পতিবার বলেন, প্রতারকেরা অভিনব কৌশল ব্যবহার করে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর এসব কৌশল সম্পর্কে ধারণা নেই।