দেশের প্রায় সব গ্রামে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) দিনে চাহিদার তুলনায় ৩০ শতাংশ কম বিদ্যুৎ পাচ্ছে। অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চাহিদার অর্ধেকে নেমে এসেছে। এতে লোডশেডিং পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কোথাও কোথাও লোডশেডিং হচ্ছে ১০ ঘণ্টার বেশি।
আরইবির তথ্য অনুযায়ী, গত শনিবার ৯ হাজার ৫৬৫ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে তারা পেয়েছে ৬ হাজার ৭৯৮ মেগাওয়াট। গত বছরের তুলনায় এদিন সরবরাহ কম ৪৪০ মেগাওয়াট। আর গত রোববার ৯ হাজার ৪১৭ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ছিল ৬ হাজার ৭১৪ মেগাওয়াট। গত বছরের একই দিনের তুলনায় সরবরাহ কমেছে ৬৩৬ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে ডলার–সংকটের কারণে জ্বালানি সাশ্রয়ে গত বছর জুলাইয়ে পরিকল্পিত লোডশেডিং শুরু করে সরকার। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং টানা তিন মাসের বেশি সময় লোডশেডিংয়ে ভুগেছে মানুষ। শীত শুরুর পর কিছুটা স্বস্তি আসে। এখন লোডশেডিং হচ্ছে গত বছরের চেয়েও বেশি। এবার স্বস্তি আনতে পারে বৃষ্টি। এমন পরিস্থিতির জন্য জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভর পরিকল্পনাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানী ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। এ দুই সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গতকালও বেশির ভাগ এলাকায় দিনে অন্তত তিনবার করে লোডশেডিং হয়েছে। দুটি সংস্থা মিলে ঘণ্টায় লোডশেডিং করেছে ৬০০ মেগাওয়াটের মতো।
ঢাকার বাইরে সিটি করপোরেশন ও পৌর শহরগুলোয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো), নেসকো ও পিডিবি। শহরের পাশাপাশি কিছু জেলার গ্রামেও পিডিবি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। তবে দেশের মোট বিদ্যুৎগ্রাহকের ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ পায় আরইবির সমিতি থেকে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, কুমিল্লা ও রাজশাহী অঞ্চলের গ্রাম এলাকায় ১২ ঘণ্টা লোডশেডিংয়েরও খবর পাওয়া যাচ্ছে। চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট, বরিশালের গ্রামগুলোয় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকার অভিযোগ করছেন গ্রাহকেরা। রোববার সারা দেশে আরইবি সর্বোচ্চ লোডশেডিং করেছে ২ হাজার ৭০৩ মেগাওয়াট।
উত্তরাঞ্চলের শহর এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে নর্দান ইলেকট্রিক কোম্পানি (নেসকো)। দিনাজপুর নেসকো ডিভিশন-২–এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামাল বলেন, ৩০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ হয়েছে ১২-১৪ মেগাওয়াট
সংস্থাটির নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য–উপাত্ত দেখে নেসকো-২–এর সুইচ বোর্ড অ্যাটেনডেন্ট ফারুক আহমেদ বলেন, দিনাজপুর শহরের গণেশতলা এলাকায় রোববার দুপুর ১২টা থেকে সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে আটবার। তিনি কোন কোন সময় বিদ্যুৎ ছিল না, তার হিসাবও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, রোববার দুপুর একটা থেকে আড়াইটা, বিকেল ৫টা ৩৫ থেকে সন্ধ্যা ৭টা ৫, রাত ৯টা ৫ থেকে রাত ১০টা ১০, রাত ১২টা ৩০ থেকে রাত দেড়টা, ভোর ৪টা ১৫ থেকে ৫টা ১৫, সকাল ৬টা ২৫ থেকে ৬টা ৫৫, সকাল ৮টা ৩০ থেকে সকাল ১০টা ৫৫—এ সময়ে বিদ্যুৎ ছিল না। এ হিসাবে ২৪ ঘণ্টায় ৯ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না।
বগুড়ায় ১১০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ রয়েছে গড়ে ৫০ মেগাওয়াট। ফলে দিনে-রাতে ১২ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
নেসকোর বগুড়া অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) হাসিবুর রহমান বলেন, গড়ে মোট চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে এখন।
চাহিদার অর্ধেক সরবরাহ
বেশির ভাগ জেলায় সমিতির মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আরইবি। কোনো কোনো জেলায় একাধিক সমিতি আছে। এগুলো পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি নামে পরিচিত। এসব সমিতির আওতায় একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। চাহিদার তুলনায় অর্ধেকের কম সরবরাহ পাচ্ছে যেসব সমিতি, তাদের এলাকায় ১২ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং দিতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে।
কুষ্টিয়া জেলার সবচেয়ে বেশি গ্রাহক পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির। গতকাল বেলা একটায় লোডশেডিং ছিল ৫১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এর আগে বেলা ১২টায় লোডশেডিং দিতে হয়েছে ৫০ দশমিক ৪০ শতাংশ। সমিতির কর্মকর্তারা বলছেন, গড়ে ২৪ ঘণ্টায় ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।
কুষ্টিয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার এস এম নাসির উদ্দীন বলেন, প্রতি ঘণ্টায় চাহিদার তুলনায় অর্ধেক বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে।
গাজীপুর পল্লিবিদ্যুৎ সমিতি থেকে প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ৪৬২ মেগাওয়াট। তার বিপরীতে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ মেগাওয়াট। গাজীপুর পল্লিবিদ্যুৎ সমিতি-১–এর উপমহাব্যবস্থাপক (টেকনিক্যাল) জাহিদুল ইসলাম বলেন, সোমবার দুপুর পর্যন্ত ৩৯ শতাংশ লোডশেডিং রয়েছে।
দিনাজপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ জানায়, ১১০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ মেগাওয়াট।
খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক মো. জিল্লুর রহমান বলেন, সরবরাহে ৩০ শতাংশ ঘাটতি থাকছে। মাঝেমধ্যে আরও বেড়ে যায়।
ওজোপাডিকোর নির্বাহী পরিচালক (পরিচালন) মোহা. শামছুল আলম জানান, বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলা শহর ও ২০টি উপজেলা শহর এলাকায় ঘাটতি ছিল ১৫৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
রাজশাহীতে একদিকে অতিরিক্ত লোডশেডিং, অন্যদিকে অব্যাহত তাপপ্রবাহ। রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার নওপাড়া গ্রামের আজিজুল ইসলাম বলেন, রাতে দিনে মিলে ১২ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না। একবার গেলে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং থাকছে। রাতে ঘুমের কষ্ট হচ্ছে।
রাজশাহী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক রমেন চন্দ্র রায় বলেন, চাহিদার তুলনায় ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত।
মানুষ ভুগছে
দিনাজপুরে গত এক সপ্তাহে ৪০-৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে ওঠানামা করছে তাপমাত্রা। জেলার সদর উপজেলার চেহেলগাজী ইউনিয়নের বাঁশেরহাট এলাকার বাসিন্দা আসমাউল হুসনা বলেন, দিনে–রাতে কম করে ১০ থেকে ১২ বার বিদ্যুৎ যায়। একবার গেলে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পরে আসে। প্রায় একই অভিজ্ঞতা বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলা গৃহিণী চম্পা বানুর। তিনি বলেন, গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে লোডশেডিং।
গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক আমিনুল ইসলাম বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে হাসপাতালে রোগীদের খুবই খারাপ অবস্থা হচ্ছে। অস্ত্রোপচারের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।
সপ্তাহখানেক ধরে খুলনার গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং অসহনীয় হয়ে উঠেছে। দিন-রাত মিলিয়ে কোথাও কোথাও ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা, আবার কোথাও ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। শহরে কিছুটা কম। ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মীম আক্তার বলেন, রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত ৬ বার বিদ্যুৎ গেছে।
সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলা সদরের রিফাতপুর গ্রামের বাসিন্দা শামীম আহমদ বলেন, রাতে নিয়ম করে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হলেও দিনের বেলায় তা অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
সিলেট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১–এর মহাব্যবস্থাপক মো. আক্তারুজ্জামান লস্কর বলেন, চাহিদা ছিল ১০৪ মেগাওয়াট, সরবরাহ ছিল ৭৬ মেগাওয়াট। আর সিলেট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২–এর মহাব্যবস্থাপক সঞ্জীব কুমার রায় বলেন, সোমবার সকালে লোডশেডিং ৩৫ দশমিক ৭১ শতাংশ।
ব্যাহত হচ্ছে কারখানার উৎপাদন
খুলনায় চিংড়ি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, চিংড়ি পচনশীল পণ্য। বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ট্রাস্ট সি ফুড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল হক বলেন, ১ ঘণ্টা থাকে তো ২ ঘণ্টা থাকছে না বিদ্যুৎ। প্রতিদিন শুধু ১ হাজার ২০০ লিটার ডিজেল লাগছে। যাতে প্রতিদিন সোয়া লাখ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে।
বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেক চাল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আইলচারা এলাকার গোল্ডেন অটো রাইস মিলের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহিনুজ্জামান।
নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটী বিসিক শিল্পনগরীতে গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে ২১৫টি, ডাইং কারখানা সাতটি, নিটিং (সুতা থেকে কাপড় তৈরি) কারখানা চার শতাধিক। নিটিং কারখানাগুলো পুরোটাই বিদ্যুৎনির্ভর এবং রপ্তানির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ৯৫ শতাংশ কারখানার জেনারেটর নেই। এতে উৎপাদন প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে বলে কারখানা সূত্রে জানা গেছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছে না
বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বলছে, এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বাড়ছে। রোববার রাতে সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয়েছে ৩ হাজার ২১৫ মেগাওয়াট। আর গতকাল দিনের বেলাতেই সর্বোচ্চ লোডশেডিং ছিল ২ হাজার ৮১৫ মেগাওয়াট। তবে গত এক সপ্তাহের তথ্য বলছে, মধ্যরাতের পর তিন ঘণ্টা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং থাকে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে গতকাল আরও ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন কমে গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। শিগগিরই এটি বাড়বে বলে কোনো আভাস নেই। বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা থাকলেও জ্বালানির অভাবে তা কাজে লাগছে না। দিনে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট উৎপাদনের রেকর্ড থাকলেও এখন ১৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এতে চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি বাড়ছে। আর ঘাটতি পূরণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করছে দেশের ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম বলেন, গত বছর আদানি ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন শুরু আর প্রকৃতির ভরসায় সংকট উত্তরণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যথাসময়ে ওই দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসেনি। শীত তখন বাঁচিয়েছে। এবারও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর আশ্বাস দিচ্ছে সরকার। তবে তা থেকে পায়রা বন্ধের ঘাটতি পূরণ হতে পারে, লোডশেডিং কমবে না। তাই আবারও প্রকৃতির ওপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই।