বরেণ্য সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ১৩ আগস্ট মঙ্গলবার। গত বছরের এই দিনে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি প্রয়াত হন। সাংবাদিকতার বাতিঘরখ্যাত গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার পরিবার, সমকালসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
ঢাকায় তার উত্তরার বাসভবনে এবং তার জন্মস্থান বরিশালের বানারীপাড়ায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
গোলাম সারওয়ারের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে সমকাল পরিবার। মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁর কবরে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পুষ্পার্ঘ অর্পণ শেষে গোলাম সারওয়ারের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত করা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন সমকালের বার্তা সম্পাদক মশিউর রহমান টিপু, প্রধান প্রতিবেদক লোটন একরাম, ফিচার সম্পাদক মাহবুব আজীজ, বার্তা সম্পাদক (অনলাইন) গৌতম মণ্ডল, মহাব্যবস্থাপক (সার্কুলেশন) হারুন অর রশিদ, বিশেষ প্রতিনিধি আবু কাওসার, সাহাদাত হোসেন পরশ, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ওয়াকিল আহমেদ হিরণ, ফসিহ উদ্দিন মাহতাব, জ্যেষ্ঠ ফটো সাংবাদিক কাজল হাজরা ও স্টাফ রিপোর্টার রাজবংশী রায়।
পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটির পর দৈনিক সমকাল ও গোলাম সারওয়ার ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে এই পথিকৃৎ সম্পাদকের প্রথম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে স্মরণসভার আয়োজন করা হবে।

মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীল মূল্যবোধ আর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সোচ্চার গোলাম সারওয়ার ছিলেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব। ষাটের দশকে সাংবাদিকতার শুরু থেকে একটানা পাঁচ দশকের বেশি সময় তিনি এ পেশায় মেধা, যুক্তিবোধ, পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার নিরবচ্ছিন্ন চর্চায় নিজেকে এবং বাংলাদেশের সংবাদপত্রকে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
গোলাম সারওয়ারের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১ এপ্রিল বরিশালের বানারীপাড়ার এক সল্ফ্ভ্রান্ত পরিবারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা হিসেবে তার সাংবাদিকতা পেশার সূচনা। একই বছর দৈনিক সংবাদের সহ-সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন তিনি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত সংবাদে চাকরিরত ছিলেন গোলাম সারওয়ার। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন নিজ এলাকা বানারীপাড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের পর কয়েক মাস বানারীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে সিনিয়র সহ-সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে প্রধান সহ-সম্পাদক, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

সংবাদপত্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বার্তা বিভাগে গোলাম সারওয়ারের সৃজনশীলতা, সংবাদবোধ ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এদেশের সংবাদমাধ্যম জগতে উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। দৈনিক ইত্তেফাকে দীর্ঘ ২৭ বছর বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি সাপ্তাহিক পূর্বাণীর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। তিনি দেশের দুটি সেরা দৈনিক ‘যুগান্তর’ ও ‘সমকাল’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেন। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক এবং এর ৬ বছর পর ২০০৫ সালে আরেকটি নতুন দৈনিক সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। আমৃত্যু তিনি দৈনিক সমকালের সম্পাদক ছিলেন। একই সময়ে বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি সৃজনশীল সাহিত্যেও ছিল গোলাম সারওয়ারের অবাধ বিচরণ। ‘রঙিন বেলুন’ নামে শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত ছড়ার বইটি তার ছড়া সৃষ্টির উজ্জ্বল নিদর্শন। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘সম্পাদকের জবানবন্দি’, ‘অমিয় গরল’, ‘আমার যত কথা’, ‘স্বপ্ন বেঁচে থাক’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ২০১৭ সালে তার ৭৫তম জন্মবার্ষিকীতে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, সহকর্মী, বন্ধু, স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের লেখনীতে সমৃদ্ধ স্মারকগ্রন্থ ‘সুবর্ণরেখায় বাতিঘর’ প্রকাশিত হয়।
সাংবাদিকতায় জীবনব্যাপী ভূমিকার জন্য গোলাম সারওয়ার ২০১৪ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়াও ২০১৬ সালে কালচারাল জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ (সিজেএফবি) আজীবন সম্মাননা এবং ২০১৭ সালে আতাউস সামাদ স্মারক ট্রাস্ট আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন। এ বছর বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল তাকে মরণোত্তর বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল পদকে ভূষিত করে। মেধা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার উৎকৃষ্টতার কারণে গোলাম সারওয়ারকে অনেকেই ‘সাংবাদিকদের শিক্ষক’ হিসেবে অভিহিত করেন। তার হাতে গড়া পাঁচ শতাধিক সাংবাদিক এখন দেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও টেলিভিশন মাধ্যমে নিজ নিজ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।