গর্ভবতী মা পুষ্টি না পেলে কম ওজনের শিশু জন্মায়: আইসিডিডিআরবির গবেষণা

0
105
গর্ভবতী মায়ের প্রতীকী ছবি
  • ৫৪ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভকালে প্রয়োজনীয় ওজন বৃদ্ধি পায় না।
  • ১০ শিশুর ৪টিই কম ওজন নিয়ে জন্ম নিচ্ছে।
  • অন্তঃসত্ত্বা নারীর ২ হাজার ২০০ কিলোক্যালরি সুষম খাবার খাওয়া প্রয়োজন।

    গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত সুষম খাবারের অভাবে মায়ের ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে কম। এতে কম ওজনের শিশু জন্ম নিচ্ছে। আর এই অপুষ্টির দুষ্টচক্রে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের মা ও শিশুরা।

    আইসিডিডিআরবির গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। দেশের একটি এলাকার অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ওপর ওই গবেষণা চালানো হয়। গতকাল মঙ্গলবার আইসিসিডিআরবি কার্যালয়ের সাসাকাওয়া সম্মেলনকক্ষে এক অনুষ্ঠানে ওই গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরা বলা হয়, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রতি দুজনের একজনের গর্ভকালীন ওজন কম বেড়েছে।

    এ কারণে প্রতি ১০ শিশুর চারজনই কম ওজন নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। আবার গ্রামের তুলনায় শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারের অন্তঃসত্ত্বা নারীরা প্রাণিজ আমিষ, জিংক ও স্নেহজাতীয় খাবার কম খাচ্ছেন।

    গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত সুষম খাবারের অভাবে প্রভাব পড়ে গর্ভের শিশুর ওপর। সেই শিশুর খর্বকায় ও কম বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়ার শঙ্কা থাকে।

    ‘স্পটলাইন অন ম্যাটারনাল নিউট্রিশন ইন বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশে মাতৃপুষ্টির ওপর আলোকপাত) শীর্ষক অনুষ্ঠানে দুটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরেছে আইসিসিডিডিআরবি। গবেষকেরা জানান, দারিদ্র্য ও অসচেতনতার কারণে দেশে পুষ্টির অভাবে গর্ভকালে

    প্রয়োজনের তুলনায় মায়েদের কম ওজন বাড়ে। এতে কম ওজনের শিশু জন্ম নেয়। সেই শিশু খর্বকায় ও কম বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়ার আশংকা থাকে। এই শিশুদের কৈশোরও অপুষ্টির মধ্য দিয়ে যায়। অপুষ্টির শিকার মেয়ে শিশুটি পরিণত বয়সেও অপুষ্টির অভাবে ভুগতে পারে এবং সে পরে মা হলে আবারও অপুষ্ট শিশু জন্ম নেয়। এটা অপুষ্টির একটি দুষ্টচক্র।

    গবেষণায় গর্ভাবস্থায় সুষম খাদ্যগ্রহণ, চিকিৎসকসেবা নেওয়া এবং মা ও শিশু পুষ্টির গুরুত্ব নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

    ৫৪% মায়ের গর্ভাবস্থায় কম ওজন বৃদ্ধি

    ‘মাতৃপুষ্টি’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির পুষ্টি গবেষণা বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী এস এম তাফসীর হাসান। তিনি বলেন, চাঁদপুরের মতলব উপজেলায় আইসিডিডিআরবির হেলথ রিসার্চ সেন্টারে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সেবা নেওয়া অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মধ্যে ১ হাজার ৮৮৩ জনের ওপর গবেষণা চালানো হয়। এতে দেখা গেছে, ৫৪ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভকালে যতটুকু ওজন বাড়া উচিত, তা বাড়েনি।

    হাসপাতালে একই সময় সেবা নেওয়া ১ হাজার ৪৬৩ মা ও নবজাতকের ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, গর্ভকালে কম ওজন বেড়েছে এমন মায়ের সন্তানদের ৩৯ শতাংশ কম ওজন নিয়ে জন্ম নিয়েছে।

    তাফসীর হাসান বলেন, সাধারণত গর্ভে ৩৯–৪০ সপ্তাহ পূর্ণ করে জন্ম নেওয়া শিশুর ওজন ২ হাজার ৫০০ গ্রামের কম হলে কম ওজন ধরা হয়। অবশ্য ২৯ বা ৩২ সপ্তাহ বা বিভিন্ন সপ্তাহ পূর্ণ করে জন্ম নেওয়া ছেলে–মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে কম ওজন পরিমাপের তারতম্য আছে। এসব বিবেচনায় দেখা গেছে, ৩৯ শতাংশ শিশু গর্ভের বয়স অনুযায়ী কম ওজন নিয়ে জন্মাচ্ছে।

    তাফসীর বলেন, গবেষণায় প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ওজনের ২০ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা মা–ও ছিলেন। অতি ওজনের অন্তঃসত্ত্বা নারীর অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম (সিজারিয়ান সেকশন), অতিরিক্ত ওজনের শিশু জন্ম, অপরিণত শিশু জন্ম হলে নবজাতকের অসুস্থতার ঝুঁকি বাড়ে।

    গর্ভকালে কতটুকু ওজন বৃদ্ধি প্রয়োজন এমন প্রশ্নে তাফসীর বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব মেডিসিন বলছে, সে দেশের অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভাবস্থায় পুরো সময়ে অন্তত ৯ কেজি ওজন বৃদ্ধি উচিত। বাংলাদেশের নারীদের ক্ষেত্রে সেটি পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়।

    বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বাংলাদেশসহ কম উন্নত দেশগুলোতে মায়েদের গর্ভকালীন ওজন কতটা বাড়া উচিত, তা বের করতে চলতি বছর ১৬ বিজ্ঞানীর একটি টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করেছে। বাংলাদেশ থেকে তিনি ওই গ্রুপে রয়েছেন। তিন বছরের মধ্যে গবেষণার ফল দেওয়া যাবে।

    সুষম খাবার খাওয়ার হার কম

    অনুষ্ঠানে ‘গর্ভাবস্থায় সুষম খাবার’ শিরোনামে আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির পুষ্টি গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানী মোস্তফা মাহফুজ।

    ২০২২ সালে রাজধানীর মিরপুরের একটি বস্তির ৪৫ ও মতলবের ৪৭ অন্তঃসত্ত্বা নারীর খাবার গ্রহণের হার তুলনা করে দেখা যায়, গ্রামের তুলনায় শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারের নারীদের প্রাণীজ আমিষ, জিংক ও স্নেহজাতীয় খাবার খাওয়ার হার কম। তবে শহরের অন্তঃসত্ত্বা নারীরা গ্রামের নারীদের তুলনায় ভাত বেশি খান। শহর ও গ্রামের অন্তঃসত্ত্বা নারীরা মাত্র ২৬ শতাংশ ক্যালসিয়াম, ৪২ শতাংশ আয়রন ও ৩১ শতাংশ ভিটামিন ‘এ’ যুক্ত খাবার খান।

    মোস্তফা মাহফুজ বলেন, একজন নারীর দিনে ১ হাজার ৯০০ কিলোক্যালরি সুষম খাবার খাওয়া প্রয়োজন। আর অন্তঃসত্ত্বা নারীকে কমপক্ষে আরও ৩০০ কিলোক্যালরি বেশি খাবার খেতে হবে।

    ভাত কম খেয়ে অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়া বাড়াতে হবে। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের পরিবারের সদস্যদের কিছু ভুল ধারণা আছে। যেমন তাঁরা মনে করেন, ওজন কম হলে গর্ভের শিশু কম বাড়বে এবং সহজে স্বাভাবিক প্রসব হবে।

    মোস্তফা মাহফুজ বলেন, দেশে প্রসবপূর্ব চিকিৎসাসেবা নেওয়ার হারও কম। প্রসবপূর্ব এই সেবা অন্তত চারবার নেওয়াসহ সুষম খাবার খেতে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও পরিবারের সদস্যদের কাউন্সেলিং করতে হবে।

    অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.