শুক্রবার রাত ৯টা। মিরপুরের দারুস সালাম থানার সামনে শতাধিক লোকের জটলা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অনেক নারী-শিশু। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে থানার সামনে ভিড়ও বাড়ে। ‘দীপ্তি’ নামে একটি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন তাঁরা। হতভাগাদের অধিকাংশ নিম্ন আয়ের। কেউ পোশাককর্মী, কেউ গৃহকর্মী, অনেকে আবার দিনমজুর। অনেক কষ্ট করেও ভাগ্য ফেরাতে দারুস সালামের লালকুঠি এলাকায় যে প্রতিষ্ঠানে তাঁরা ছোটখাটো সঞ্চয় করছিলেন, তারা উধাও হয়ে গেছে। মাস চারেক ধরে দীপ্তির কার্যালয় বন্ধ দেখে অনেকে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। চেষ্টা-তদবির ও অনেক খোঁজাখুঁজির পর প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার সঙ্গে জড়িতদের নাগাল পাচ্ছিলেন না। গরিবের ঘামে ভেজা কষ্টের টাকা মেরে দেয় তারা।
গতকাল রাতে মাইকিং করে থানায় আসতে বলা হয় ভুক্তভোগীদের। থানার সামনে অন্তত ২০ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। অনেকে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কুলছুম বেগম তাঁর জীবন সংগ্রামের কথা বলতে বলতে বারবার অশ্রু মুছছিলেন। পেশায় তিনি গৃহকর্মী। মাসে ৭-৮ হাজার টাকা রোজগার করেন। তাঁর স্বামী জাকির হোসেন রাজমিস্ত্রি। কিডনির অসুস্থতার কারণে অনেক দিন ধরে কুলছুমের স্বামী কাজে যেতে পারছেন না। ১৬ বছরের মেয়ে জাকিয়া আক্তার, ৫ বছরের ছেলে আব্দুল্লাহ ও স্বামী নিয়ে সংগ্রামের জীবন তাঁর। কুলছুমের আয়ের ওপর কোনোভাবে টিকে থাকে পরিবারটি। এত কষ্টের পরও মাসে ৬০০ টাকা করে দীপ্তিতে জমা করে আসছিলেন তিনি। ওই প্রতিষ্ঠানের একটি জমা বই দেখিয়ে কুলছুম বললেন, ‘১৬ হাজার ২০০ টাকা জমা হয়েছে আমার। কয়েক মাস ধরেই লোকজন বলাবলি করছিল, ওরা সবার টাকা মেরে দিয়ে চলে যাবে। এর পর অফিসে গেলে ধমক দিয়ে ফিরিয়ে দেয়। টাকা না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছি। আমরা গরিব মানুষ। কার কাছে গিয়ে নালিশ দিব।’
হতভাগা আরেকজন হলেন স্মৃতি রানী সূত্রধর। তিনিও পেশায় গৃহকর্মী। নিজের অসুস্থ শরীর নিয়ে ছুটা বুয়ার কাজ করে মাসে ৫ হাজার রোজগার তাঁর। তাঁর স্বামী দীপক ছোটখাটো কাজ করেন। দুই মেয়ে পুষ্প ও জয়াকে নিয়ে কষ্টের সংসার স্মৃতির। বসবাস করেন দারুস সালামের বসুপাড়ায়। স্মৃতি বললেন, প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে জমা করতাম। ১৭ মাস ধরে জমা দিয়ে আসছি।
জানুয়ারি মাসে টাকা তুলতে গেলে ঝাড়ি মেরে অফিস থেকে বিদায় করে। কিছুদিন পর দেখি অফিস তালাবদ্ধ।’ এই সমিতির প্রতারণায় যারা পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই নিম্ন আয়ের নারী। রাবু আক্তার রাখী নামে আরেক নারী বললেন, মাসে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে তিন বছর ধরে জমা দিচ্ছেন। সমিতিতে আর টাকা জমা রাখতে চান না– এটা জানানোর পর ভয়-হুমকি দেওয়া হয়। অনেক চেষ্টায় ৫৫ হাজার টাকা তুলতে পেরেছেন। এখনও সমিতির কাছে ৩০ হাজার টাকা পাবেন।
সানজিদা বেগম নামে আরেকজন জানালেন, ওই সমিমিতে ৪ লাখ টাকা তাঁর এফডিআর করা ছিল। এ ছাড়া মাসে ১০ হাজার টাকার একটি ডিপিএস করেছিলেন। গত সেপ্টেম্বরে ডিপিএসের মেয়াদ শেষ হলেও এখনও টাকা পাননি। এমনকি এফডিআর ভাঙতে দিচ্ছে না।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ব্যাংক থেকেও অধিক লাভ দেওয়ার কথা বলে দারুস এলাকায় কয়েকশ ব্যক্তিকে সমিতির সদস্য করা হয়। সেখানে কারও ছিল এফডিআর। কেউ আবার মাসে মাসে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ সঞ্চয় রাখতেন।
দারুস থানার ওসি আমিনুল বাশার জানান, শুক্রবার শাহিদা আক্তার নামে একজন ভুক্তভোগী দীপ্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর পরই অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ পরিচালককে গ্রেপ্তার করা হয়। এটা জানাজানির পর পরই আরও অনেকে থানার সামনে জড়ো হন। যাঁদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাঁদের বেশিরভাগ গরিব।
পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, দীপ্তির সঙ্গে জড়িতরা ৫ কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করে। তবে বাস্তবে টাকার অঙ্ক আরও বেশি। এটা ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকার কম নয়। এক সময় সাভারসহ আরও কয়েকটি জায়গায় তাদের কার্যালয় ছিল। ওই সব অফিস গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের একাধিক পরিচালকের ঢাকায় আলিশান বাড়ি রয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা হলেন– মো. শাহজাহান, আব্দুল খালেক, খন্দকার গোলাম মোস্তফা, আবদুল মালেক ও জাহাঙ্গীর আলম। এখনও পলাতক রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের আরও ১৩ জন। তার মধ্যে রয়েছেন– রোজিনা মালেক, মান্নান সোহাগ, পানু তানমী, আহমাদুর রহমান, ইমাম হোসেন দুলাল, উৎপল চন্দ্র ঘরামী, শাহিন মিয়া প্রমুখ।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আব্দুল খালেক বলেন, অনেকের সঞ্চয়ের অর্থ তাঁরা ক্ষুদ্র ঋণ হিসেবে বিতরণ করেছেন। সেই অর্থ ফেরত পাওয়ার আগেই যাঁরা সঞ্চয় করেছেন, তাঁরা অর্থ ফেরত চাচ্ছেন। আবার করোনার কারণে তাঁরা বিপাকে পড়ে যান। এ কারণে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে পারছিলেন না।