গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে পিছিয়ে সরকার

0
156
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা বা জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনা হচ্ছে। আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম গণহত্যা হলেও জাতিসংঘে বা আন্তর্জাতিক প্রাতিষ্ঠানিক কোনো দলিলে এর স্বীকৃতি এখনও নেই। যথাসময়ে বাংলাদেশ সরকার ও উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান তথ্যপ্রমাণ গ্রন্থিত করে এর উদ্যোগ না নেওয়ায় এ অবস্থা।

এখন বেসরকারি সংগঠনগুলোর তৎপরতাও রয়েছে অনেক। সরকারের উদ্যোগ কার্যত থমকে আছে। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে জাতীয়ভাবে দেশে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালিত হচ্ছে।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার তথ্যউপাত্ত নিয়ে আমরা ডকুমেন্টারি তৈরি করেছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আমরা যৌথভাবে কাজ করছি। পরিস্থিতি যখন অনুকূলে আসবে অর্থাৎ জাতিসংঘে ভোট হলে ফল বাংলাদেশের পক্ষে আসবে, তখনই সরকার প্রস্তাব উপস্থাপন করবে। এ জন্য বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগকেও স্বাগত জানাই। কিছু প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে জাতিসংঘে স্বীকৃতি আদায়ের ব্যাপারে প্রস্তাব দিয়েছে, স্মারকলিপি দিয়েছে। এটি ইতিবাচক।’

তবে মন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন গণহত্যা-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসানের মতে, বেসরকারি উদ্যোগে ব্যক্তি ও সংগঠনের করা কোনো একটি প্রস্তাব যদি জাতিসংঘে উত্থাপনের পর নাকচ হয়ে যায়, তাহলে সরকারের তরফ থেকে স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়ে আর কিছু করার থাকবে না। তাই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় প্রয়োজন। সরকারকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। নয়তো সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ।

সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব বলেন, ‘আমরা যেভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার স্বীকৃতি পেয়েছি; তেমনিভাবে ১৯৭১ সালের গণহত্যারও স্বীকৃতি আনতে হবে। এ জন্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রবাসী, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। বিশ্ববিবেক আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযানও জোরদার করা প্রয়োজন।’

এদিকে সরকারের উদ্যোগ থমকে থাকলেও গত ছয় মাসে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে বেসরকারি উদ্যোগ লক্ষ্যণীয়। গত ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতি চেয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে পৃথক স্মারকলিপি দিয়েছে বেসরকারি কয়েকটি সংগঠন। র‍্যালি ও সমাবেশের পাশাপাশি গত সেপ্টেম্বরে গণহত্যা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ ভবনে সেমিনার আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া গত ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতির দাবিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদেও (হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস) একটি প্রস্তাব আনা হয়। দেশটির দুই আইনপ্রণেতা ‘বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতি’ শীর্ষক আট পৃষ্ঠার ওই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। মার্কিন কংগ্রেসে প্রস্তাবটি উত্থাপন বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত হয়। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে ছিল।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ পরিচালক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি দিলে গণহত্যা বন্ধের পথ আরও প্রশস্ত হবে নিঃসন্দেহে। সে জন্য দেশটির দু’জন আইনপ্রণেতা যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা সাধুবাদযোগ্য। এ দাবিতে আমাদেরও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

জেনোসাইড: ইংরেজি ‘জেনোসাইড’ শব্দটি বাংলায় ‘গণহত্যা’ বলে আমরা প্রকাশ করি। গ্রিক ভাষার ‘জেন’ বা ‘গোষ্ঠী’ ও লাতিন ‘সাইডো’ বা ‘বিনাশ’ থেকে আসা ইংরেজির প্রত্যয় ‘সাইড’ যুক্ত করে এই শব্দ অধুনা তৈরি। জেনোসাইড শুধু ‘ম্যাস কিলিং’ বা ‘ব্যাপক হারে হত্যা’ নয়। শব্দটি আইনগত তাৎপর্যে গ্রহণযোগ্য। বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠী বা ধর্ম-বর্ণ ও বিশ্বাসের মানুষের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত পন্থায় পরিচালিত ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, আক্রমণ ও পীড়ন, যা সেই জনগোষ্ঠীকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়, সেটাই জেনোসাইড।

জাতিসংঘের ১৯৪৯ সালের ‘জেনোসাইড কনভেনশন’-এ এই সংজ্ঞা স্বীকৃত। এ কারণে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের হাতে যে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ঘটে, তা সব অর্থেই ‘গণহত্যা’ বা ‘জেনোসাইড’।

গণহত্যা সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশি তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, তা ছিল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম নৃশংস গণহত্যা। প্রায় ৩০ লাখ লোক শহীদ হন। স্বাধীনতার পর থেকেই গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, গণহত্যা জাদুঘরসহ নানা সংগঠনের প্রচেষ্টায় গত কয়েক দশকে গণহত্যার স্বীকৃতির দাবি জোরালো হয়। বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষও গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে দেশে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে।

সংসদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার  প্রস্তাবে বলা হয়, ‘সংসদের অভিমত এই যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হোক এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হোক।’

এরপর ওই বছর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে আর তার ধারাবাহিকতা অনুসরণ করা হয়নি।

সংকট ও করণীয়: বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক শাহরিয়ার কবির বলেন, সংকট অনেক। কারণ, জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোতে ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালন করা হচ্ছে। ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ১৯৩টি দেশ ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের জন্য সর্বসম্মত ভোট দিয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশও ছিল। এখন সেই বাংলাদেশ যদি ৯ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব করে, তা মোটেই কার্যকর হবে না। এ জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা দায়ী। তবে সরকার চাইলে ২৫ মার্চের জেনোসাইডের স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে, এটি হলেও আমাদের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় হবে।

বিষয়টি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের নজরে নেওয়া হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি ভেবে দেখার দরকার আছে। আমাদের পথচলা একসঙ্গে। বিষয়টি নিয়ে আলাপ করে দেখব।’ তিনি এ সময় গণত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সরকারের পদক্ষেপও তুলে ধরেন।

মন্ত্রী বলেন, ‘২৫ মার্চের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় অনেকটা কঠিন হয়ে গেছে। তবে আমরা আশা ছাড়ছি না। আমরা এখন ভিন্ন কৌশলে অর্থাৎ গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়ে জনমত গঠন করতে চাইছি। প্রতিটি হাইকমিশনে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে কর্মসূচির আয়োজন করা হচ্ছে। যে বিদেশিরা দেশে এবং হাইকমিশনে আসছেন, তাঁদেরকে গণহত্যার বিষয়টি জানানো হয়। তাঁদের থেকে শিগগিরই স্বাক্ষর সংগ্রহ করার পরিকল্পনাও আমাদের রয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে পরবর্তী সময়ে আমরা আবার জাতিসংঘের কাছে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করব।’ তাঁর মতে, অতীতের সরকারগুলো গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা না করায় এমন পরিস্থিতি হয়েছে। গণমাধ্যমগুলো তখন কোনো প্রশ্ন তোলেনি। তাই দায় সবারই আছে।

বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকলেও বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানি বর্বরতার বিষয়টি স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আর্জেন্টিনা, হংকং, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। একাধিক বিদেশি গবেষকও একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ কিছু কোর্স ও গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও বছরব্যাপী গণহত্যাবিষয়ক বিভিন্ন ধরনের সংক্ষিপ্ত কোর্স ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে।

বিশ্বব্যাপী উনিশ শতক থেকে নৃশংস গণহত্যার মধ্যে রয়েছে– আর্মেনীয় গণহত্যা, হলোকাস্ট ও ন্যানকিং গণহত্যা, কম্বোডীয় গণহত্যা, একাত্তরের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের নামে বাঙালি গণহত্যা, বসনীয় গণহত্যা, বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ডের গণহত্যা, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা এবং সবশেষ ইউক্রেনে রাশিয়ার গণহত্যা। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) একাত্তরের ২৫ মার্চ সূচিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা জঘন্যতম। ওইদিন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এক রাতেই প্রায় ৫০ হাজার বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.