খাতুনগঞ্জে অস্থির পেঁয়াজ বাজার

0
189
পেঁয়াজ বাজার

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম নিয়ে চলছে অস্থিরতা। কয়েক দিনের ব্যবধানে তিন দফায় কেজিতে দাম বেড়েছে ৪০ টাকা। এখন ভালো মানের এক কেজি পেঁয়াজ খুচরায় কিনতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। অথচ এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেও এক কেজি পেঁয়াজ ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় কেনা যেত। অভিযোগ রয়েছে, কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। তবে কয়েক দফা পেঁয়াজের দাম বাড়লেও প্রশাসন নীরব।

ক্যাবসহ সংশ্লিষ্টদের দাবি, সিন্ডিকেট করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন কেউ কেউ। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকায় সরবরাহ ঘাটতিতে সংকট তৈরি হয়েছে। এ কারণে দামও বাড়ছে। আমদানি ছাড়া দেশি পেঁয়াজ দিয়ে বাজার সামাল দেওয়া অসম্ভব।

এদিকে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়েছে বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়। দাম নিয়ন্ত্রণে শিগগির পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সংস্থা দুটি। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গেল এক মাসে শুধু দেশি পেঁয়াজের দামই সর্বোচ্চ ৮৬ শতাংশ বেড়েছে।

ব্যবসায়ীরা বাজারে দেশি পেঁয়াজের সংকট থাকার কথা বললেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে ভিন্ন কথা। সরকারি এই সংস্থার মতে, গত চার বছরের ব্যবধানে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ১৩ লাখ টনের বেশি। তবে উৎপাদনের প্রভাব নেই বাজারে। উল্টো বাড়ছে দাম। বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিতেই কারসাজি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে দাবি ভুক্তভোগীদের। এ অবস্থায় প্রকৃত পক্ষে বাজারে সংকট নাকি সিন্ডিকেটের কারসাজিতে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখতে বাজার তদারকির ওপর জোর দিয়েছেন ক্যাবসহ সাধারণ ভোক্তারা।

পরিসংখ্যান বলছে, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি যখন বন্ধ থাকে, তখন দেশের বাজারে দাম বেড়ে যায়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কয়েক বছর পেঁয়াজের দাম হঠাৎ কয়েক গুণ বাড়ার পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে খাতুনগঞ্জের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকের জড়িত থাকার প্রমাণ পায় খোদ প্রশাসন। সরকার গত ১৫ মার্চ থেকে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্র বন্ধ করে দেয়। যে কারণে বর্তমানে চাহিদার পুরোটা মেটানো হচ্ছে দেশি পেঁয়াজ দিয়ে। দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও দাম ছুটছেই। এখন খাতুনগঞ্জের মোকামে পাবনা, ফরিদপুর ও কুষ্টিয়া থেকে পেঁয়াজ আসছে।

এ ব্যাপারে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা কয়েক টাকা লাভে কমিশন ভিত্তিতে ব্যবসা করেন। পেঁয়াজ দ্রুত পচনশীল পণ্য। সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় খাতুনগঞ্জে মজুত করারও সুযোগ নেই। তাই পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজির সুযোগ নেই। তবে কারসাজি কেউ যে করছে না, তা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে বড় ব্যবসায়ী ও পেঁয়াজের উৎপত্তিস্থলের কেউ জড়িত থাকতে পারে। কিছু আমদানিকারকও সুযোগকে কাজে লাগাতে পারেন।’

খাতুনগঞ্জের কাঁচাপণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান কাজী স্টোরের স্বত্বাধিকারী জাবেদ ইকবাল বলেন, ‘বাজারে যে পরিমাণ পেঁয়াজ সরবরাহ হচ্ছে, তা চাহিদার তুলনায় কম। এ কারণে দামও দফায় দফায় বাড়ছে। তবে যেসব দেশি পেঁয়াজের দাম এখন খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে ৭০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোর দাম থাকার কথা ৩০ টাকার আশপাশে। দেশি পেঁয়াজ মূলত যেসব স্থান থেকে এখানে আসছে, সেখানকার ব্যবসায়ী, আড়তদার ও মিল মালিকরা কারসাজির সঙ্গে জড়িত কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা উচিত।’

এ ব্যাপারে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা সবসময় অজুহাত আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। অতীতে এর বেশ কিছু প্রমাণও পেয়েছি আমরা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হচ্ছে। বাজারে সরবরাহও ভালো। সরকার কৃষকদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ ঘোষণার পর প্রায় দেড় মাস স্বাভাবিক ছিল পেঁয়াজের দাম। তখনও দেশি পেঁয়াজ বাজারে ছিল। কয়েক দিনে দাম বেড়ে ৭০ টাকার ওপরে চলে গেছে।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘জুনের শেষের দিকে কোরবানির ঈদ। ঈদে বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে এখন থেকেই পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনলে আসল সত্য বেরিয়ে আসবে। কয়েক দফা দাম বাড়ার পরও সরকারি সংস্থাগুলো নীরব। এর খেসারত দিচ্ছেন ভোক্তারা।’

চট্টগ্রাম নগরের কর্ণফুলী মার্কেটে বাজার করতে আসা চাকরিজীবী কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘কয়েক দিন আগেও ভালো মানের যে পেঁয়াজের কেজি ৬০ টাকায় কিনেছি, একই পেঁয়াজ এখন দাম চাইছে ৮০ টাকা। এটি কারসাজি ছাড়া আর কিছুই না।’ আরেক ক্রেতা আমীর হোসেন বলেন, ‘ঈদুল ফিতরের পরও প্রতি কেজি পেঁয়াজ মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় কিনেছি। এখন ৭৫ থেকে ৮০ টাকার নিচে পেঁয়াজ মিলছে না। ছোট সাইজের যে পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৩০ টাকায় কিনেছি, একই পেঁয়াজ এখন কিনতে হচ্ছে ৭০ টাকায়।’

খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী চন্দন কুমার পোদ্দার বলেন, ‘খাতুনগঞ্জের বাজার ভারতনির্ভর। এখন কয়েকটি এলাকা থেকে দেশি পেঁয়াজ এলেও তা চাহিদার তুলনায় কম। পেঁয়াজ আমদানি না হলে দাম আরও বাড়বে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে কোরবানি ঈদে।’

আমদানির অনুমতি দেওয়ার চিন্তা

দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম সহসা না কমলে কৃষি মন্ত্রণালয় ভারত থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠান শেষে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্র কৃষি মন্ত্রণালয় দিয়ে থাকে। কৃষকরা যেন ন্যায্যমূল্য পান, সে জন্য আমদানি করা হচ্ছে না। কৃষি মন্ত্রণালয় বাজার পর্যবেক্ষণ করছে। যদি দাম না কমে, তাহলে তারা ভারত থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত নেবে।

এর আগে পেঁয়াজের দাম বাড়ার বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে সচিবালয়ে গত রোববার কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয় দেশের অভ্যন্তরে পেঁয়াজের বাজার তদারকি করছে। উৎপাদন ও মজুত বিবেচনায় দেশে এই মুহূর্তে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই; অথচ বাজারে দাম কিছুটা বেশি। এভাবে দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকলে শিগগির পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হতে পারে।’

শৈবাল আচার্য্য, চট্টগ্রাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.