খরচের বোঝা বাংলাদেশের, চুক্তিতে লাভ আদানিরই

0
184
গৌতম আদানি। ফাইল ছবি

ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে ২৫ বছরের জন্য বিদ্যুৎ আমদানি শিগগির শুরু হতে যাচ্ছে। যদিও এ বিদ্যুৎ কিনতে আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সম্পাদিত ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) নিয়ে দেশ-বিদেশে হচ্ছে নানা সমালোচনা। হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনে আদানির বৈশ্বিক বাণিজ্যে ধস নামলেও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটির জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য সংশ্নিষ্টদের।

আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত পিপিএ এবং সমমানের অন্য দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের পিপিএ বিশ্নেষণ করে খাতসংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাব করা হয়েছে ট্যারিফ ফর্মুলায়। ফলে পিপিএতে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। পিপিএ অনুসারে ক্যাপাসিটি চার্জের পরিবর্তনশীল অংশটি সময়ের সঙ্গে কমবে। প্রথম বছর মাসে প্রতি কিলোওয়াটের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয়েছে ২১.৮৯২৭ ডলার। ২৫তম বছরে তা কমে হবে ১৪.৬২৭০ ডলার। ক্যাপাসিটি চার্জের অপরিবর্তনশীল অংশটি আদানির পিপিএতে প্রতি কিলোওয়াট/মাসে ৩ দশমিক ৬৫ ডলার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পিপিএতে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে কস্টপ্লাস ফর্মুলায়। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ সময়ের সঙ্গে অনেক কমে আসবে।

পাওয়ার সেলের সাম্প্রতিক এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির থেকে আনা বিদ্যুতে ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি পড়ছে। চীন-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ইউনিটপ্রতি ২ টাকা ৮৩ পয়সা। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের কেন্দ্রের বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের ক্যাপাসিটি চার্জ ৪ টাকা ৭১ পয়সা। বরগুনার বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ ইউনিটপ্রতি ধরা হয়েছে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা। অথচ আদানির ঝাড়খণ্ডের কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ প্রতি ইউনিটে ৪ টাকা ৫৫ পয়সা।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক আদানি ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ না কিনলেও আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ৪৭৩.১৬ মিলিয়ন ডলার। ২৫ বছরে এ চার্জ পরিশোধে বাংলাদেশের খরচ হবে প্রায় ১১.৮৩ বিলিয়ন ডলার।

কয়লায় কারসাজি

চুক্তি অনুসারে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি খরচ পিডিবি বহন করে, যা বিদ্যুতের দামের সঙ্গে যুক্ত থাকে। পিপিএতে উল্লেখ করা থাকে জ্বালানি মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতি। পিপিএ বিশ্নেষণকারী একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পিপিএতে কয়লার দর নির্ধারণে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আদানির চুক্তিতে এমন সুযোগ নেই। আদানির পিপিএর শিডিউল ৬-এর টেবিল সিতে কয়লার দর নির্ধারণের ফর্মুলা দেওয়া আছে। এটি অনুসারে দর নির্ধারণে ইন্দোনেশিয়ান কোল ইনডেক্স এবং নিউ ক্যাসেল ইনডেক্সের গড় হিসাব করা হবে। এ ছাড়া ৪৬০০ কিলোক্যালরির কয়লা ব্যবহার করলেও ৪৬০০ এবং ৬৩২২ কিলোক্যালরির কয়লার মিশ্র দাম নিতে পারবে আদানি। তবে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার পর সম্প্রতি ঢাকায় কয়লার দর নিয়ে পিডিবির সঙ্গে বৈঠক করেছে আদানি পাওয়ার ঝাড়খণ্ডের এমডিসহ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। তারা পায়রার মতো ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টরে দর নির্ধারণে রাজি হয়েছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ছাড় দিলেও আদানির বিদ্যুতের দাম বেশি হবে। কারণ পায়রা বা রামপালের কয়লা বিদেশ থেকে সমুদ্রপথে এসে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংশ্নিষ্ট জেটিতে খালাস হয়। কিন্তু আদানির ঝাড়খণ্ডে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা তাদেরই মালিকানাধীন অস্ট্রেলিয়ার কারমাইকেল খনি থেকে সমুদ্রপথে এসে প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণাধীন উড়িষ্যার ধামারা বন্দরে খালাস হওয়ার কথা রয়েছে। সেখান থেকে রেলপথে ৭০০ কিলোমিটার দূরে ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে নেওয়া হবে। এতদূর পথ কয়লা পরিবহন খরচের পাশাপাশি একাধিক রাজ্যের ট্যাক্স-ভ্যাট ইস্যু রয়েছে। সব মিলিয়ে কয়লার চূড়ান্ত দর বেড়ে যাবে। আদানি ওয়াচের বিশ্নেষণ অনুসারে, প্রতিষ্ঠানটির কয়লার দর প্রচলিত মূল্যের চেয়ে তিন গুণ হবে।

গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিকে অসম, অস্বচ্ছ ও বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে তা সংশোধন এবং প্রয়োজনে চুক্তি বাতিলের পরামর্শ দিয়েছে। একই পরামর্শ দিয়েছে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশও।

চুক্তি নিয়ে কথা বলতে আদানির ঢাকা অফিসের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান দাবি করেন, আদানির বিদ্যুৎ অন্য কেন্দ্রগুলোর মতোই হবে। এতে বাংলাদেশের লোকসান হবে না বরং উত্তরাঞ্চলে লোডশেডিং থেকে পরিত্রাণ মিলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.