প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের ছাঁটাই হওয়া কর্মীরা কেন এত আনন্দে

0
150
চাকরি হারানোর ঘটনা সুকি লানের ক্যারিয়ারের বড় ধরনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ছবি: লিংকডইন থেকে নেওয়া

সুকি লান আর্থিক-প্রযুক্তি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ২০২২ সালের জুলাইয়ে যখন তিনি শুনলেন, প্রতিষ্ঠানের ছাঁটাই হতে যাওয়া ২০ জন কর্মীর মধ্যে তিনিও আছেন, তখন তিনি অজানা শঙ্কায় মুষড়ে পড়েছিলেন। চাকরি চলে গেলে কী হবে—এই ভাবনায় অস্থির হয়েছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে ফ্লোরিডার টাম্পা এলাকার ৩১ বছর বয়সী সুকি ওই প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানে কপিরাইটার ও সোশ্যাল মিডিয়া ক্রিয়েটিভ প্রডিউসার হিসেবে এক বছরের বেশি সময় কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মী ছাঁটাই চলছে, এটা দেখে শুরুতে ভয় পেয়েছিলাম। কয়েক মাস হয়তো বেকার থাকতে হবে এ নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম।’

সুকি লানের লিংকডইন পোস্ট।

সুকি লানের লিংকডইন পোস্ট।

তবে চাকরি হারানোর কয়েক দিন পর থেকেই তাঁর অনুভূতি ইতিবাচকভাবে বদলে যেতে থাকে। সাবেক সহকর্মী ও বন্ধুদের সঙ্গে ভিন্ন রকম স্বাধীনতার পথ তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘চাকরি হারানোর পর সাবেক সহকর্মী ও বন্ধুদের সঙ্গে আরও প্রাণ খুলে আড্ডা দিতে পেরেছি। মনে হয়েছে, আরও ক্ষমতায়িত হয়েছি। এ নিয়ে আমি বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলাম।’

এই ঘটনার অল্প কিছুদিন পরই সুকি তাঁর ভিডিওগ্রাফির দক্ষতা ব্যবহার করে ৪০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও চিত্র তৈরি করেন। চাকরি হারানোর পর অবসর সময় তিনি এগুলো করেছেন। নিজের নতুন শখগুলোকে হাইলাইট করে তৈরি করা ভিডিও চিত্রটি তিনি পেশাজীবীদের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনের প্রোফাইলে পোস্ট করেন।

সুকি ভিডিও চিত্রটি মূলত তাঁর বন্ধুদের হাসানোর জন্য তৈরি করেছিলেন। এরপরও পোস্টটিতে হাজার লাইক ও ভিউ হয়েছে। বিষয়টি অসংখ্য নিয়োগকারীর নজরে এসেছে। এর এক মাসের মধ্যে সাতটি কোম্পানি তাঁর চূড়ান্ত পর্যায়ের সাক্ষাত্কার নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। আর দুটি প্রতিষ্ঠান সিনিয়র কপিরাইটার হিসেবে ৫০ শতাংশ বেতন বেশি দিয়ে চাকরির প্রস্তাব দেয়। ফ্রিল্যান্স হিসেবে একই রকম ভিডিও চিত্র তৈরি করার জন্য বিভিন্ন ব্র্যান্ডও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল।

চাকরি হারানোর ঘটনা সুকির ক্যারিয়ারের বড় ধরনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘চাকরিটা না হারালে এসব সুযোগ আসত না। আমি নিজের লক্ষ্য পূরণে পরিকল্পিতভাবে এগোতে পছন্দ করি। জীবনের এই আকস্মিক পরিবর্তন আমাকে শিখিয়েছে, জীবনে অনেক কিছু হবে—এর জন্য কোনো সঠিক মুহূর্ত নেই।’

বিশ্বের অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান গত কয়েক মাস থেকে কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বৈশ্বিক চাকরির বাজারের অবস্থা এখন অস্থির। কয়েক দশক ধরে চাকরি করা কর্মীরাও ছাঁটাইয়ের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও উচ্চ বেতনের কর্মী আছেন। অনেকের কাছে এই ছাঁটাই জীবনে একটা বড় ধরনের আঘাত। এর প্রভাবে তাঁরা আর্থিক স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যবীমা, আত্মবিশ্বাস বা এমনকি পেশাগত পরিচয়ের দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

গত বছর দুই হাজারের বেশি মার্কিন কর্মীর ওপর লিংকডইন একটি জরিপ করেছে। সেই জরিপে দেখা গেছে, ২৭ শতাংশ মানুষ চাকরি হারানোকে তাঁদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সেরা ঘটনা হিসেবে দেখেছেন। কেউ কেউ নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেছেন; অন্যরা পছন্দের চাকরি খুঁজে পেয়েছেন অথবা তাঁদের কর্মজীবনের ভারসাম্য পুনর্মূল্যায়ন সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন।

চাকরি হারিয়ে ল্যান্স গোল্ড এখন নিজেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক।

চাকরি হারিয়ে ল্যান্স গোল্ড এখন নিজেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। 
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

চাকরি হারানো ব্যক্তিরা বলেছেন, তাঁরা জীবনে এমন সুযোগ খুঁজে পেয়েছেন, যা কর্মক্ষেত্র থেকে ছাঁটাই না হলে হতো না। এ থেকে সদ্য ছাঁটাই হওয়া কর্মীরাও আনন্দে থাকার উৎসাহ পাবেন।

‘অস্তিত্বগত পুনর্বিন্যাস’

তবে অল্পসংখ্যক মানুষ সরাসরি ছাঁটাই হওয়ার সম্ভাব্য ইতিবাচক দিক হয়তো খুঁজে পান। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কোচ গেন্না ক্লার্ক বলেন, মানুষ নেতিবাচক বিষয়ের দিকে বেশি আগ্রহী হয়। পরিবর্তনটি মানুষ পছন্দ করে না যেমন ছাঁটাই করা, এর নেতিবাচক পক্ষপাত অনেক বেশি। এটা নতুন এবং হুমকি। এতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকে।

এ কারণেই নিউইয়র্কভিত্তিক ল্যান্স গোল্ড যখন জানতে পারলেন ২০১৬ সালে এওএলের ছাঁটাই করা ৫০০ কর্মীর মধ্যে তিনিও একজন, তখন তিনি প্রাথমিকভাবে আর্থিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিমা হারানোর আতঙ্কে ছিলেন। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে হাফিংটন পোস্টে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করা সত্ত্বেও তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ৫০ বছর বয়সের কারও পক্ষে শীর্ষ প্রকাশনায় অন্য কোনো পদে চাকরি পাওয়া কতটা সহজ হবে?

এসব ভয় কাটাতেই তিনি চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন। এরপর দুটি ভিন্ন পদে চাকরির জন্য কয়েকবার সাক্ষাত্কার দিলেও সেই চাকরি তিনি পাননি। তিনি বলেন, ‘চাকরি যখন পেলাম না, তখন ভেবেছি নিজে কিছু করব।’

ল্যান্স গোল্ড বলেন, চাকরি হারানোর আগে তিনি কখনো নিজের ব্যবসা শুরু করার বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করেননি। চাকরি হারানোর কারণে নতুন কিছু করার চিন্তা তাঁর মাথায় ঢুকে পড়ে। পরে তিনি দ্রুত সিলিকন ভ্যালি স্টোরি ল্যাব নামে কনটেন্ট ফার্মের সহপ্রতিষ্ঠা হয়ে যান।

লন্ডনভিত্তিক সাইকোথেরাপিস্ট এলোইস স্কিনার বলেন, ল্যান্স গোল্ডের অভিজ্ঞতা অস্বাভাবিক নয়। ছাঁটাই মানুষকে তাঁদের ক্যারিয়ার ও নিজেদের পুনর্মূল্যায়ন করার সুযোগ এনে দেয়।

এলোইস স্কিনার বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে ছাঁটাইয়ের বিষয়টি কর্মীদের নিজের আরও গভীরে যেতে সহায়তা করে। এই সময়কে “অস্তিত্বগত পুনর্নির্মাণের” সময় হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। কারণ, বিষয়টি আমাদের আরও গভীর, আরও অর্থপূর্ণ স্তরে নিজেদের বোঝার সুযোগ দিতে পারে। যখন অন্য কোনো চাকরি খোঁজার প্রসঙ্গ আসে, তখন আমরা নিজেদের সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে পারি। এই বিষয়গুলো শেষ পর্যন্ত আরও পরিপূর্ণ ক্যারিয়ারের দিকে নিয়ে যেতে পারে।’

নতুন সুযোগের অপেক্ষা

যাঁরা কর্মক্ষেত্রে নিজ নিজ কাজকে উপভোগ করছেন, ছাঁটাইয়ের অভিজ্ঞতা তাঁদের জন্য নতুন পথ খুলে দিতে পারে।

২০২০ সালের জুলাইয়ে উড়োজাহাজশিল্প স্থগিত হয়ে গেলে সারা গোল্ডিং ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ থেকে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়েছিলেন। তিনি ৩২ বছর এই এয়ারওয়েজে কাজ করেছেন। শেষের দিকে তিনি কেবিন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন। করোনাকালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১২ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়।

ওয়েলশের বাসিন্দা ও দুই সন্তানের মা সারা বলেছেন, ‘এই কাজ আমার পছন্দ ছিল। উড়োজাহাজে ভ্রমণের প্রেমে পড়েছিলাম। অবসর না নেওয়া পর্যন্ত এটাকেই আমার একমাত্র কাজ ভেবেছিলাম। অন্য কিছু করব এটা কখনো কল্পনাও করিনি।’

সারার বয়স এখন ৫৫। উড়োজাহাজের চাকরি ছাড়ার পর তিনি ওয়েলশ অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসে আর্জেন্ট-কেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন। চাকরিটা পেয়ে শুরুতে হতভম্ব হয়েছিলেন তিনি। উড়োজাহাজে ওড়ার বদলে অ্যাম্বুলেন্সে চাকরি! কিন্তু এই চাকরিই তাঁর জীবনে দুর্দান্ত কিছু অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছে। নতুন অনেক কিছুই শিখেছেন এবং অসংখ্য মানুষকে সাহায্য করছেন তিনি।
এর মধ্যে হঠাৎই সারার মায়ের মৃত্যু হয়। বাসায় পারকিনসন্স রোগে ভোগা বাবা। তাঁর সেবার জন্য আর বাইরে থেকে কর্মী না খুঁজে নিজেই এই কাজ করেছেন সারা। এর তিন মাসের মধ্যেই তাঁর বাবাও মারা যান। আগের প্রতিষ্ঠানে কাজ করলে এই সুযোগটা পেতেন না সারা।

সারা বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবায় যোগদান করায় আমার বাবাকে তাঁর প্রয়োজনের সময় সাহায্য করতে পেরেছি।’

প্রথম চাকরি ছাড়ার দুই বছর পেরিয়ে গেছে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ আবারও সারাকে খণ্ডকালীন নিয়োগ দিয়েছে। পাশাপাশি তিনি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসেও কাজ করছেন। দুই চাকরির মাঝে এখন ভারসাম্য রক্ষা করে চলছেন তিনি। এতে সারাও বেশ আনন্দিত।

গঠনমূলক শিখন অভিজ্ঞতা

ল্যান্স গোল্ডের বয়স এখন ৫৭। এখনো তিনি চাকরি হারানোর বাজে অভিজ্ঞতার কথা ভুলতে পারেন না। প্রথম ব্যবসায় সফলতার পর তিনি ২০২১ সালে ব্রুকলিন স্টোরি ল্যাব নামে আরও একটি ব্যবসা চালু করেছেন।

ল্যান্স গোল্ড বলেন, ‘আমাকে বাধ্য হয়ে এই নতুন কাজ করতে হয়েছে। প্রতিদিন এই কাজ অদ্ভুত ও রোমাঞ্চকর। জীবনে এমন ঘটছে বলে আমি কৃতজ্ঞ। কাজটি এতটাই অর্থপূর্ণ যে আমি ব্যক্তিগত ও পেশাগত দিক থেকে সন্তুষ্ট।’

সুকি লানও চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের পর অনেক গঠনমূলক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি বলেন, ‘একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া অন্য মানুষের সঙ্গে পরামর্শ ভাগ করে নিতে পারছি। একজন পরামর্শদাতা আমাকে বলেছিলেন, ছাঁটাই সব সময় ভালো কিছুর দিকে নিয়ে যায় এবং আমি তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’

গত জুলাইয়ে ছাঁটাইয়ের পর থেকে সুকির পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে। চলতি মাসে তাঁর নতুন নিয়োগকর্তা চুক্তি পর্যালোচনা করার সময় তাঁকে ৩০ দিনের জন্য বিরতি দিয়েছিলেন। এরপরও তিনি বলেন, ‘আমি নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার সুযোগের জন্য প্রস্তুত।’ তবে চাকরি হারানোর কারণে সবার ক্ষেত্রে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা হবে না। এর কারণে আর্থিক ও মানসিক অনেক চাপ পড়ে, যা মোকাবিলা করা অনেক সময় কঠিন হতে পারে। তারপরও এ থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.