দিন যায় কথা থাকে’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝরনা বলো’, ‘তুমি যে আমার কবিতা’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’—এমন অনেক জনপ্রিয় গানের শিল্পী সুবীর নন্দী। আজ শিল্পীর মৃত্যুদিনে জানা যাক কেন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তাঁর গান?
দিন যায় কথা থাকে… থেকে যায় সুরের কথকতা। তবে সব কথা পেরোয় না কালের সীমা। কিছু কথায় অমরত্ব বুনে দিয়ে যান শিল্পী নামের স্রষ্টা। সুবীর নন্দী—বাংলা গানের ভুবনে তেমনি এক অবিস্মরণীয় নাম। প্রয়াণের চার বছর পেরিয়েছে। অথচ চার–পাঁচ দশক আগে গাওয়া তাঁর গান আজও অমলিন শ্রোতার হৃদয়ে। কিসের গুণে এ মায়ার খেলা চলছে অবিরাম?
সুবীর নন্দীর জন্ম, বেড়ে ওঠা আর দারুণ সংযমী জীবনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, একটি সংগীত পরিবারে তাঁর বেড়ে ওঠা, সিলেট অঞ্চল ও তার গীতল প্রতিবেশ, ধ্রুপদি ও লোকগানের তালিম গড়ে দিয়েছে তাঁর ভিত্তিভূমি। পরবর্তীকালে গুণী সুরকার আর গীতিকারের সংস্পর্শে তিনি বেতার, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে উপহার দিয়েছেন কালজয়ী সব গান। শুধু গায়নদক্ষতা আর সুন্দর লিরিক ও সুরের সমবায়ে সুবীর নন্দী স্বকীয় শিল্পী হয়ে উঠেছেন, তা নয়। খেয়াল রাখা জরুরি, সুবীর নন্দী বাংলা গানের বিশেষত বাংলাদেশে গানের একটা বাঁকবদলের সাক্ষী এবং অন্যতম সারথিও বটে। এই বাঁকবদলের স্বরূপ না বুঝে শুধু সুমিষ্ট কণ্ঠের শিল্পী হিসেবে সুবীর নন্দীকে উদ্যাপন করলে খামতি থেকে যায়।
প্রথমত, আধুনিক বাংলা গানের একটা সুবর্ণ সময় সূচিত হয়ে আছে ১৯৪০-এর দশক থেকে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্রসহ খ্যাতিমান শিল্পীদের একটা প্রবল দাপুটে যুগ চলল প্রায় ষাটের দশক পর্যন্ত। বাংলা গানের দিগন্ত প্রায় তাঁদের নিয়েই। এই উত্তরাধিকার নিয়ে নতুন সুর ও স্বরের নির্মাণ সহজ ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। এর ওপর ছিল রাজনৈতিক পালাবদলের ডামাডোল। সব মিলিয়ে চাই নতুন যুগের গান, নতুন হাওয়া।
এই নতুন সময়ে সংগীত ভুবনে এলেন সুবীর নন্দী। কবীর সুমন প্রায়ই যেমন বলেন, তানসেন হওয়ার আগে কানসেন হওয়া জরুরি, অর্থাৎ শ্রুতির পরিপূর্ণ বিকাশ শিল্পীর জন্য অতীব জরুরি। সিলেট অঞ্চলের গীতল হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা পুতুল রানীর নিকট গানে হাতেখড়ি, বাবা সুধাংশু নন্দীর গ্রামোফোন রেকর্ডের বিশাল সংগ্রহ শৈশবেই তাঁর শ্রুতির পূর্ণতা এনে দিয়েছিল। সমঝদার পাঠক হয়তো কিংবদন্তি সলিল চৌধুরীর একই রকম বেড়ে ওঠার সঙ্গে সাযুজ্য খুঁজে পাবেন। চা–বাগান, বাগানিয়াদের সংস্পর্শ, গান, লোকজ সুর, অর্থাৎ প্রতিবেশ কী করে শিল্পীকে ঋদ্ধ করে, তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর হয়ে আছেন যেমন সলিল চৌধুরী, নিবিড় পাঠে সুবীর নন্দীর শৈল্পিক উদ্ভাসনেও তা চিহ্নিত করা সম্ভব।
ফিরে আসি বাঁকবদল প্রসঙ্গে। ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীত এবং লোকগানের গুরু বিদিত লাল দাসের কাছে লোকসংগীতের শিক্ষা সুবীর নন্দীকে তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। তাঁর গানে লোকজ সংগীতের মাধুর্যের সঙ্গে রাগাশ্রয়ী গায়ন আধুনিক বাংলা গানে স্বতন্ত্র নমুনা নিঃসন্দেহে, যা রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রোত্তর যুগের গান থেকেও স্বকীয়। পাশাপাশি সিলেট অঞ্চলের মরমি গানের রেশ, বাউল গানের ভাব আর বিচ্ছেদী গানের আবেগ তাঁর কণ্ঠে অপূর্ব সমবায়ে অনন্যতা পেয়েছে। এ কারণেই সুবীর নন্দীর জনপ্রিয় গানগুলোতে পল্লিগানের সরল বয়ান, নৈসর্গিক দৃশ্যকল্প অনেক বেশি চেনা। তাঁর গানে উড়ালপঙ্খী, বাউল মন, আরেক নয়ন ইত্যাদি সহজিয়া প্রতীক বহুস্তরিত বয়ান হাজির করে, অথচ তিনি পল্লিগানের প্রথাগত শিল্পী নন। এসব গানের গীতিকারেরাও এই নাগরিক পাটাতনের মানুষ। এখানেই শিল্পীর অনন্যতা। আবহমান বাংলার ভাবের যে আবহ, তা নাগরিক জমিনে দাঁড়িয়েও উদ্ভাসিত তাঁর গানে। পাঁচ দশকজুড়ে তাঁর অসামান্য জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণও এটি। একই সঙ্গে শাস্ত্রীয় সংগীতের কালোয়াতি এড়িয়ে এসব গানের মাধুর্য সম্প্রসারণে তাঁর সযত্ন এবং সফল প্রয়াস লক্ষণীয়, ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’, তাই শ্রোতার হৃদয়ে আজও হাহাকার তৈরি করে।
চলচ্চিত্রের গানের সূত্রেই তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা ও স্বীকৃতি মিললেও এটা স্মরণে রাখা রাখা দরকার যে তাঁর জনপ্রিয়তম একাধিক গান আগেই জনপ্রিয় হয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় চলচ্চিত্রে এসেছে। ‘সুবীর নন্দীর গান’ শিরোনামে নিজের প্রথম একক অ্যালবামের সাফল্যও সেই সাক্ষ্য দেয়। তাঁর জনপ্রিয় গানগুলো সবার কমবেশি জানা, তবে এই জনপ্রিয়তার সূত্রসন্ধানী প্রয়াস চোখে পড়ে না। অথচ সুবীর নন্দীর জনপ্রিয়তার সূত্র সন্ধান করলেই দেখা যাবে, গেল শতকের সত্তরের দশক থেকে বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে গুণী সুরকার, গীতিকার আর শিল্পীদের কী অসামান্য অবদানে বাংলাদেশের গান একটা স্বকীয় চেহারা লাভ করেছে। এ সময়ের গানের ভাষায়ও দারুণ কাব্যিক ও সহজিয়া কথার মালা দেখা যাবে, সুবীর নন্দীর মতো গুণী শিল্পীরা তার যথার্থ ব্যবহারই করেছেন। ‘পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝরনা বলো’, ‘তুমি যে আমার কবিতা’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’ ইত্যাদি গানে যে কাব্যিকতা, তা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে দারুণ আদর পেয়েছে স্বাভাবিকভাবেই, আবার ‘ও আমার উড়ালপঙ্খীরে’, ‘নেশার লাটিম’, ‘বন্ধু তোর বরাত নিয়া আমি যাব’ ইত্যাদি গান সব ধরনের শ্রোতার হৃদয় ছুঁয়েছে। কালিদাসের মেঘ নাকি তোমার মাথার চুলের মতো উৎপ্রেক্ষার বাহার এ শিল্পীর অজস্র গানেই পাওয়া যায়। তবে তা এতটুকুও দুর্বোধ্যতার অভিযোগে দুষ্ট নয়। এখানেই সুবীর নন্দী অনন্য।
বেতার, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের গানে এমন স্বচ্ছন্দ যাতায়াত, লোকগান আর ধ্রুপদি গানের অপূর্ব সমন্বয়, গানের করণকৌশলগত বোঝাপড়া আর অন্তর্গত ভাবের উৎসারণ, যা তাঁর আশৈশব প্রকৃতিলগ্ন জীবনের অর্জন—এসবের সমবায়ই সুবীর নন্দীকে অনন্য করে তুলেছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে নতুন দেশে নতুন গানের তৃষ্ণা, বেতার ও টেলিভিশনের উত্থানপর্ব এবং বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিকেও অনুকূল করে তুলেছিল। নাগরিকতার প্রবল দাপটে গণমানুষের সঙ্গে শিল্পনির্মাতাদের যোগাযোগের সাঁকোটিও তখন অটুট ছিল বলে নাগরিক চৌহদ্দিতে নির্মিত এবং আদৃত হতে পেরেছিল, ‘মাস্টার সাব আমি নাম–দস্তখত শিখতে চাই’–এর মতো গান। প্রসঙ্গত, খান আতাউর রহমান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সত্য সাহা, আলম খান, শেখ সাদী প্রমুখ কীর্তিমানদের সৃজনসম্ভারে সে যুগ যে পরিপূর্ণ ছিল, তা-ও স্মরণ করা জরুরি। সুবীর নন্দী তাই সে যুগেরও নির্মাণ। আজ তাঁর প্রয়াণের চতুর্থ বর্ষপূর্তিতে এই বোঝাপড়াটুকু বরং মিলিয়ে নেওয়া যাক যে বাংলাদেশের গান কত দূর এগোল, কোন পথে এগোল, সাঁকোটুকু ভেঙে গেল কোথায়?
সুবীর নন্দীর প্রায় আড়াই হাজার গানের ভুবন ঢুঁড়ে জিজ্ঞাসাটুকু অন্তত গুছিয়ে নেওয়া যাক। নাকি দূর হতে গাইব শুধু, ‘জানি না কেন যে তার এত অভিমান’!