মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি দুঃসাহসী অভিযানের নাম ছিল কিলো ফ্লাইট। সেই চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়েই খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) একদল শিক্ষার্থী জোট বেঁধেছেন। বছর পাঁচেক আগে গড়ে তুলেছেন একটি প্ল্যাটফর্ম, নাম টিম কিলো ফ্লাইট। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি রেসিং কার নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে দলটির পথচলা শুরু।
এরই মধ্যে একটি রেসিং কারও তৈরি করে ফেলেছে তারা। কিলো ফ্লাইট আলফা নামের গাড়িটি নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিয়েছে। ২০২০ সালে যন্ত্রপ্রকৌশলীদের বৈশ্বিক সংস্থা আইমেকইর আয়োজনে যুক্তরাজ্যে একটি অনলাইনভিত্তিক ফর্মুলা স্টুডেন্ট প্রতিযোগিতা হয়। সেখানে ৫০তম হয়েছিল কুয়েট দল। পরের বছর একই প্রতিযোগিতায় ৬৪টি দেশের মধ্যে তাদের অবস্থান ছিল ৩৩তম।
তবে গাঁটের পয়সা খরচা করে কয়েক বছরের পরিশ্রমে তৈরি রেসিং কারটি এখনো প্রতিযোগিতার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যেতে পারেনি কিলো ফ্লাইট। আমন্ত্রণ অবশ্য এসেছে একাধিকবার। কখনো করোনা, কখনো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, কখনো স্পনসরের অভাব, কখনোবা ভিসা জটিলতায় কিলো ফ্লাইট আলফার দেশের গণ্ডি পেরোনো হয়নি।
এ বছর আবার সুযোগ এসেছে। জাপানের ওগাসামায়া স্পোর্টস পার্কে আগামী ২৮ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বরে হবে ফর্মুলা এসই প্রতিযোগিতার ডাইনামিক ইভেন্ট। তার আগে ২১ থেকে ২৫ আগস্ট অনলাইনে প্রতিযোগিতার স্ট্যাটিক ইভেন্টে অংশ নেবে কিলো ফ্লাইট। দলের সদস্যরা এখন ভীষণ ব্যস্ত। গাড়ি পুরোপুরি প্রস্তুত করতে শেষ সময়ের কাজ চলছে। সব ঠিক থাকলে সাক্ষাৎকারের জন্য টিম কিলো ফ্লাইটের আজ বাংলাদেশে অবস্থিত জাপানের দূতাবাসে যাওয়ার কথা।
এখনো পুরো খরচের জোগান হয়নি। তাই এবারও আছে সংশয়—প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত যাওয়া হবে তো?
কিলো ফ্লাইটের নির্বাহী সদস্য (বিজনেস ও মার্কেটিং) মো. তসলিম বলেন, ‘দলের সদস্যদের বিমান টিকিট, কুয়েট থেকে গাড়ি শিপমেন্টের মাধ্যমে জাপানে নিয়ে যাওয়া-আসা, ওয়্যার হাউস ভাড়া, প্রতিযোগিতার ভেন্যুতে থাকা এবং আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে বেশ বড় অঙ্কের অর্থ প্রয়োজন। যেহেতু টিমের সব সদস্যই শিক্ষার্থী, এই খরচ বহন করা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। কিন্তু সুযোগটা আমরা হাতছাড়া করতে চাই না। তাই নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
কুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের দুই শিক্ষার্থী এরফান ইসলাম ও সাগর মজুমদারের হাত ধরে ২০১৮ সালে কিলো ফ্লাইটের যাত্রা শুরু। পরে ২০১৭-১৮ ব্যাচের অনেকেই এই যাত্রায় যোগ দিয়েছেন। সহযোগিতা করছেন ২০২০ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। একাডেমিক পরামর্শক হিসেবে যুক্ত হয়েছেন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক। কুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা আর্থিকভাবে সহায়তা করেছেন। তাঁদের সঙ্গে নিজেদের অর্থ যোগ করে ২০১৮ সালে শুরু হয় রেসিং কার তৈরির কাজ। শুরুতে ২৮ জনের দলকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরীক্ষা, ক্লাস, করোনা, নানা কিছুর মধ্যেও কখনো ক্যাম্পাসে, কখনোবা যশোরের একটা ভাড়া করা ওয়ার্কশপে দিন-রাত কাজ চালিয়ে গেছে দলটি। অনলাইন ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে নিরলস কাজের মধ্য দিয়ে ২০২১ সালের জুলাই মাসে শেষ হয় গাড়ি তৈরির কাজ। বর্তমান ফ্লাইটের নির্বাহী কমিটিতে আছে ৩০ জন। এর বাইরে আরও অনেক সাধারণ সদস্য আছেন।
কিলো ফ্লাইটের তৈরি আলফা রেসিং কার ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৬২ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে সক্ষম। চালকের নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক সুরক্ষাব্যবস্থা। গাড়িটির আনুমানিক ওজন ৩৫০ কেজি। এতে ব্যবহার করা হয়েছে ৩৯০ সিসির একটি ইঞ্জিন। অকটেনচালিত গাড়িটি প্রতি লিটারে ৯ দশমিক ৬ কিলোমিটার অতিক্রম করতে পারে। গাড়িটির অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, এর বডি ও সিট প্যানেল পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি। রেসিং কারে পাটের আঁশ কেন? উত্তরে কিলো ফ্লাইটের নির্বাহী সদস্য শুভজিৎ বৈদ্য বলেন, ‘দেশীয় পণ্য ও পরিবেশের কথা চিন্তা করে পাট ও গ্লাস ফাইবারের কম্পোজিট ব্যবহার করে রেসিং কারটির বডি নির্মাণ করা হয়েছে, যা একই সঙ্গে মজবুত-টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব। এর ওজনও কম। মূলত, কার্বন নির্গমন কমানোর চিন্তা মাথায় রেখে আমরা এটি প্রয়োগ করি।’
টিমের ডেপুটি ক্যাপ্টেন রোকনুজ্জামান বলেন, ‘অনেক কঠিন ধাপ পেরিয়ে আমরা চূড়ান্ত পর্বে জায়গা পেয়েছি। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি আমাদের সাহায্য করে, তাহলে আশা করি, বিশ্বের দরবারে আমরা সফলভাবে বাংলাদেশি প্রযুক্তি তুলে ধরতে পারব। কুয়েট কর্তৃপক্ষ, কুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন সব সময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ যাত্রায় যোগ হয়েছে বিকাশ, জিন্স অ্যান্ড পোলো। কিন্তু বড় অংকের জন্য এখনো আমরা অনেক পিছিয়ে। আমরা তরুণ প্রজন্মকে অটোমোবাইলে আগ্রহী করতে চাই। ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক গাড়ি বানানোর পরিকল্পনাও আমাদের আছে।’ ফর্মুলা স্টুডেন্ট প্রতিযোগিতাগুলোয় পৃথিবীর ৬০ থেকে ৭০টি দেশ থেকে শিক্ষার্থীদের দল অংশ নেয়।