কুড়িগ্রামে ৮৪ বছরের পুরোনো ‘ঝন্টু মিষ্টান্ন ভান্ডার’, এক নামে চেনে সবাই

0
150
কুড়িগ্রামের 'ঝন্টু মিষ্টান্ন ভান্ডার' এর মিষ্টির সুনাম মানুষের মুখে মুখে

চারদিকে কংক্রিটের দালানের মধ্যে ছোট একটি টিনের ঘর। ঘরের সামনের দিকে কাঁচের গ্লাসের ভেতরে থরে থরে সাজানো মিষ্টি। ছোট টিনের চালা ঘরটির ওপরের দিকে একটি সাইনবোর্ড টাঙানো। সেখানে লেখা ‘ঝন্টু মিষ্টান্ন ভান্ডার’। দেখতে আর দশটা দোকানের মতো হলেও মিষ্টির মান ও স্বাদের কারণে এই দোকানের সুনাম জেলার সর্বত্র। কুড়িগ্রাম শহরের কালীবাড়ি এলাকায় এই দোকান।

বদলগাছির ‘দাদুর সন্দেশ’ মন ভোলায় সবার

ঝন্টু মিষ্টান্ন ভান্ডারের বর্তমান মালিক স্বপন বণিক। তিনি বলেন, ঝন্টু মিষ্টান্ন ভান্ডার জেলার প্রথম মিষ্টি তৈরির দোকান। ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে কুড়িগ্রামের কালীবাড়ি এলাকায় দোচালা টিনের ঘরে ঝন্টু মিষ্টান্ন ভান্ডারের যাত্রা শুরু। সে সময় কুড়িগ্রামের কোথাও মিষ্টি কিংবা চা-বিস্কুটের দোকান ছিল না। তাঁর বড় ভাই ঝন্টু লাল বণিক ১২ বছর বয়সে স্যুটকেস ব্যবসায়ী বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে চা-বিস্কুটের দোকান দেন। ব্যবসায় ছেলের দক্ষতা দেখে বাবা সুরেন্দ্রলাল বণিক ছেলেকে মিষ্টান্ন ভান্ডার করে দেন। মিষ্টান্ন ভান্ডারটি ছোট হলেও মিষ্টির মান ও স্বাদের কারণে মানুষের মুখে মুখে ঝন্টু মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

এই দোকানে চমচম, গোল মিষ্টি, মিনি মিষ্টি, ক্ষীরমোহন, রসমঞ্জুরি, ছানার সন্দেশ তৈরি করা হয়
এই দোকানে চমচম, গোল মিষ্টি, মিনি মিষ্টি, ক্ষীরমোহন, রসমঞ্জুরি, ছানার সন্দেশ তৈরি করা হয়

স্বপন বণিক বলেন, ১৯৮৫ সালে তিনি বড় ভাই ঝন্টু লাল বণিকের সঙ্গে দোকানটি দেখভাল করতে শুরু করেন। ২০০০ সালের দিকে তাঁর ভাই সপরিবার ভারতে চলে যায়। তখন থেকে দোকানটির মালিকানা তাঁর। ৮৪ বছর ধরে চলছে এই দোকান। এক নামে সবাই ঝন্টু মিষ্টান্ন ভান্ডার চেনে।

৫৮ বছর ধরে মন ভরাচ্ছে মানিকগঞ্জের ‘নিজামের মিষ্টি’

কীভাবে মিষ্টি বানিয়ে দীর্ঘদিন নিজেদের সুনাম ধরে রেখেছেন, জানতে চাইলে স্বপন বণিক বলেন, এই সুনাম একদিনে হয়নি। ভাইয়ের সততা, ত্যাগ আর মিষ্টির স্বাদ ও গুণগত মান ধরে রাখার চেষ্টা তাঁদের পরিচিতি এনে দিয়েছে। এ ছাড়া মিষ্টি বানাতে তাঁরা সব সময় টাটকা উপকরণ ব্যবহার করেন। ক্রেতারা যে তাঁদের বিশ্বাস করেন, সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা না করাই তাঁদের ব্যবসার সাফল্য।

৮৫ বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে ‘দত্তের মিষ্টি’র সুনাম

স্বপন বণিক বলেন, আগে কুড়িগ্রামের বিভিন্ন চরাঞ্চল ও শহরের বিভিন্ন গৃহস্থ ঘর থেকে দুধ আসত। দামেও সস্তা ছিল। কিন্তু বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী দুধ পাওয়া যায় না। তাই তাঁরা রংপুরের কাউনিয়ার এক খামারির কাছ থেকে দুধ কিনেন। সেই দুধ থেকে তৈরি হয় ঝন্টু মিষ্টান্ন ভান্ডারের হরেক রকম মিষ্টি। যখন স্থানীয়ভাবে দুধ পাওয়া যেত, তখন দৈনিক পাঁচ মণ দুধ থেকে মিষ্টি তৈরি করতেন। কিন্তু এখন বেশি খরচ দিয়ে বাইরে থেকে দুধ আনতে হয়, তাই দৈনিক দুই মণ দুধ কিনেন। সেই দুধ থেকে তৈরি হয় চমচম, গোল মিষ্টি, মিনি মিষ্টি, ক্ষীরমোহন, রসমঞ্জুরি, ছানার সন্দেশ।

এই দোকানের মিষ্টির স্বাদ অসাধারণ। যিনি একবার ঝন্টুর দোকানের মিষ্টি খেয়েছেন, কোনো কাজে শহরে এলে তাঁকে ঝন্টুর দোকানের মিষ্টি খেতে আসতেই হবে।
একরামুল হক, ক্রেতা

প্রতিটি চমচম ও গোল মিষ্টি বিক্রি হয় ২০ টাকায়, ছানার সন্দেশ ৪০ টাকায়, ক্ষীরমোহন ৫০ টাকায়। এক কেজি সন্দেশ ৬০০ টাকা; রসমঞ্জুরি, চমচম ও গোল মিষ্টি ২৮০ টাকা কেজি, ক্ষীরমোহন ৪৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।

উলিপুর উপজেলার পাঁচপীর এলাকা থেকে ঝন্টু মিষ্টান্ন ভান্ডারে মিষ্টি কিনতে এসেছিলেন একরামুল হক (৩৮)। তিনি বলেন, এই দোকানের মিষ্টির স্বাদ অসাধারণ। যিনি একবার ঝন্টুর দোকানের মিষ্টি খেয়েছেন, কোনো কাজে শহরে এলে তাঁকে ঝন্টুর দোকানের মিষ্টি খেতে আসতেই হবে।

কুড়িগ্রাম শহরের কালীবাড়ি এলাকায় এই দোকানের অবস্থান
কুড়িগ্রাম শহরের কালীবাড়ি এলাকায় এই দোকানের অবস্থান

ঝন্টু মিষ্টান্ন ভান্ডারে এখন ছয়জন কারিগর। এর মধ্যে তিনজন কারিগর প্রায় ৩০ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। তাঁদের একজন সুদর্শন রায় বলেন, ‘আমার বয়স যখন ১১ বছর, তখন থেকেই এই দোকানে কাম করি। দেখতে দেখতে ৩০ বছর পার হয়া গেল। অনেক হোটেল থেকে বেশি ট্যাকার অফার পাই। তাঁদের হোটেলে ডাকে, কিন্তু আমি যাই না। এই দোকানের ওপর একটা মায়া পড়ছে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.