এ শহরের সব মানুষেরই একটা গল্প থাকে। তবে সেই গল্পগুলো বাস্তবসম্মতভাবে খুব কমই পর্দায় উঠে আসে। দর্শক নিজেকে একাত্ম করতে পারেন—এমন গল্পের সিনেমা হাতে গোনা। এ ধারায় একেবারেই ব্যতিক্রম ‘সাবা’। মা আর মেয়ের গল্প নিয়ে সিনেমা; তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া, ঘটতে থাকা টুকরো টুকরো সময়ের গল্প। গল্পের প্রধান চরিত্রও তাঁরা, মা-মেয়ে।
একনজরে
সিনেমা: ‘সাবা’
ধরন: ড্রামা
পরিচালক: মাকসুদ হোসাইন
চিত্রনাট্য: মাকসুদ হোসাইন ও ত্রিলোরা খান
অভিনয়: মেহজাবীন চৌধুরী, রোকোয়া প্রাচী, মোস্তফা মন্ওয়ার, সুমন পাটোয়ারী, অশোক ব্যাপারী
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট
নির্মাতা মাকসুদ হোসাইনের শাশুড়ি এক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন, মাকে নিয়ে দীর্ঘ এক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যান তাঁর স্ত্রী (সিনেমার সহচিত্রনাট্যকার ও প্রযোজক) ত্রিলোরা খান। নিজেদের জীবনের সে গল্পই পর্দায় তুলে এনেছেন তাঁরা। ‘জীবন থেকে নেওয়া’, তাই বোধ হয় সাবার আবেগ এতটা ছুঁয়ে যায়।
সাবা করিম (মেহজাবীন চৌধুরী)। ২৪ বছরের তরুণী। মা-মেয়ে একসঙ্গে থাকেন। এক সড়ক দুর্ঘটনায় মায়ের শরীরের নিচের অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। বাবা লাপাত্তা। মায়ের ওষুধ, চিকিৎসক, রান্না থেকে ডায়াপার বদলানো—সব একা হাতেই সামলান সাবা। একই সঙ্গে ঘাড়ে তুলে নিতে হয় পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব। মাকে দেখভাল করে সংসার চালাতে হিমশিম খান সাবা। সারা দিন ঘরে থেকে থেকে মা-ও হয়ে ওঠেন খিটমিটে। কিছুই যেন বুঝতে চান না। কখনো তিনিই আরও কঠিন করে তোলেন সাবার জীবন। কিন্তু দিন শেষে সাবা চান তাঁর মা যেন বেঁচে থাকুন, সুস্থ থাকুন। কঠিন এই শহরে সাবাকে নামতে হয় এক অসম যুদ্ধে। মাকে বাঁচানোর এ লড়াইয়ে নিজের মনের বিরুদ্ধে কাজ করতেও তিনি দ্বিধা করেন না। শেষ পর্যন্ত কী হয়, জানতে হলে সিনেমাটি দেখতে হবে।

বিদেশের বিভিন্ন উৎসব ঘুরে দেশের প্রেক্ষাগৃহে ‘সাবা’ মুক্তি পেয়েছে ২৬ সেপ্টেম্বর। টরন্টো, রেড সি, বুসানসহ বিভিন্ন উৎসবে প্রদর্শনীর পর প্রশংসিত হয়েছে ‘সাবা’। কেন? ছবিটি দেখলেই বুঝতে পারবেন। খুব ‘সাধারণ’ গল্প হয়েও দেশের সিনেমায় এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ‘সাবা’। সিনেমার প্রধান শক্তি এর সরলতা। গল্পকে অতিরঞ্জিত করা হয়নি। এটি যেন শুধু সাবার গল্প! চরিত্রগুলোকে নির্মাতা এত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, সবকিছু মনে হয় বাস্তব। মা-মেয়ের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব যেমন উঠে এসেছে, তেমনি দারুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে সাবার মনস্তত্ত্ব।
মায়ের অসুস্থতা আর পারিপার্শ্বিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে একা এক তরুণীর সংগ্রামের গল্প হলেও সাবা দমবন্ধ বিষণ্নতার ছবি নয়। মা ও মেয়ের খুনসুটি দেখতে গিয়ে দর্শক হেসে উঠেছেন বারবার। ছোট ছোট প্রতিটি কাজ থেকেও কীভাবে আনন্দ খুঁজে নিতে হয়, নির্মাতা যেন সেটাই দেখাতে চেয়েছেন। তেমনি ‘খালি দম নিতে পারলেই কি বাঁচা হয়ে গেল’ সংলাপের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন শয্যাশায়ী মানুষের কষ্টকেও। চিকিৎসকের বারণ সত্ত্বেও মায়ের কাচ্চি নিয়ে পাগলামি ভোজনরসিক বাঙালির চরিত্রেও ফুটে ওঠে।

কীভাবে বেঁচে আছে নিম্ন আর মধ্যবিত্ত
দেশের সিনেমায় নাগরিক জীবন মানেই যেন রঙিন আলোর ঝলকানি কিংবা শহুরে প্রেমিক-প্রেমিকার মেকি দুঃখকষ্ট। সেই পথে না হেঁটে শহরের মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত পরিবারে আলো ফেলেছে সাবা; তুলে এনেছে ঘষ্টা খাওয়া দৈনন্দিন জীবন। ‘সাবা’ রাজনৈতিক সিনেমা নয়, তবে পরোক্ষভাবে ঠিকই নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন নির্মাতা। সংবাদ পাঠিকার ভয়েসওভারে ফাঁপা উন্নয়ন, দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য, আর্থিক অনিশ্চয়তায় তরুণদের বিদেশে পাড়ি দেওয়ার প্রবণতা, কোভিড–পরবর্তী বেকারত্ব যেমন এসেছে, তেমনি দেখা গেছে বাড়িতে বাড়িতে পানির সংকট। এসেছে চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা। মধ্যবিত্ত পরিবারের কেউ যখন অসুস্থ হয়, অস্ত্রোপচারের তিন লাখ টাকা জোগাড় করতে গিয়ে বিবেকটাকে পর্যন্ত জলাঞ্জলি দিতে হয়।
‘সাবা’র আরেক উজ্জ্বল দিক ক্যামেরা, পুরো সিনেমাতেই হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরায় জাদু দেখিয়েছেন বরকত হোসেন।

সাবার জীবন অনিশ্চিত, পরের মুহূর্তে কী হবে, তিনি জানেন না। ক্যামেরাও তাই অনিশ্চিতের মতোই সাবাকে অনুসরণ করেছে, সাবা ক্যামেরার কাছে আসেন না; বরং ক্যামেরাই তাঁর প্রতিমুহূর্ত অনুসরণ করে। একই দৃশ্যে কয়েকটি শট নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে, সাবার এক্সপ্রেশন আর অসহায়ত্বের একটি বিন্দুও অনুভব না করে উপায় থাকে না। বরকত হোসেন ও মেহজাবীন জুটি আগে ‘সাবরিনা’, ‘প্রিয় মালতী’তে কাজ করেছেন; তাঁদের বোঝাপড়ার প্রভাব হয়তো ফ্রেমে ফ্রেমে ধরা পড়েছে। বরকত হোসেন ‘সাবা’র সহপ্রযোজক ও পরিবেশকও, ক্যামেরায় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন।
ক্যামেরাকে যোগ্য সংগত দিয়েছে সামীর আহমেদের সম্পাদনা আর আমান আব্বাসির মিনিমাল আবহসংগীত। গল্পের প্রথম দিকে সব লাল থাকে। বারান্দা লাল, সাবার পরনে মেরুন কার্ডিগান; গল্প যত সামনে এগোয়, সব সবুজ হয়ে যায়। বোঝা যায়, সাবার জীবনে বদল এসেছে।

এই বদল আসে অঙ্কুরের (মোস্তফা মন্ওয়ার) হাত ধরে। মায়ের চিকিৎসার জন্য ব্যয়বহুল অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে সাবা চাকরির খোঁজে বের হন। নানা জায়গায় প্রত্যাখ্যানের পর অবশেষে তিনি কাজ পান হুক্কা লাউঞ্জে, যেখানে তাঁর ম্যানেজার অঙ্কুরের সঙ্গে সখ্য হয়। অঙ্কুরের সঙ্গ সাবাকে জীবন নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়, যে জীবনের স্বপ্ন তিনি এত দিন চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। একপর্যায়ে অঙ্কুর সাবাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি জীবনে কী চাও?’ প্রশ্ন শুনে সাবা থমকে যান। কারণ, জীবনে কী চান, তা তো কখনো ভাবার সুযোগই পাননি!
সাবা চরিত্রে মেহজাবীন চৌধুরী দুর্দান্ত। প্রথম সিনেমা ‘প্রিয় মালতী’ দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন নিজের অভিনয়ক্ষমতা, এ সিনেমায় যেন নিজেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিলেন। ছোট পর্দা, ওটিটি আর ‘প্রিয় মালতী’কে মনে রেখেই বলা যায়, এটি তাঁর ক্যারিয়ার-সেরা অভিনয়।
সাবার প্রতিদিনের সংগ্রাম, একটু মুক্তির আশা, দিনের পর দিন অসুস্থ মায়ের সেবা করতে করতে ভেঙে পড়া—সবই মেহজাবীন ফুটিয়ে তুলেছেন চমৎকারভাবে। সাবার মায়ের চরিত্রে ছিলেন রোকেয়া প্রাচী। অসুস্থ নারীর চরিত্রে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। মেহজাবীন আর তিনি যখন এক ফ্রেমে ছিলেন, দুজনের মধ্যে যেন অলিখিত প্রতিযোগিতা চলছিল অভিনয়ের। মোস্তফা মন্ওয়ারও ছোট চরিত্রে ছিলেন যথাযথ। ছোট চরিত্রে সুমন পাটোয়ারী, অশোক ব্যাপারীও ঠিকঠাক।

সাবায় সাদা বা কালো কোনো চরিত্র নেই। অঙ্কুর দেশের দুর্নীতি নিয়ে বিরক্ত, কিন্তু বিদেশে যাওয়ার জন্য ‘অন্য রকম’ কিছু করতে দ্বিধা করেন না। আবার সাবাও নিজের সবচেয়ে অসহায়ত্বের সময়ে প্রিয় বন্ধুকে ফাঁসিয়ে দেন।
তবে সিনেমাটি নিয়ে কিছু কিন্তু থেকেই যায়। বিশেষ করে সাবার মতো পোড় খাওয়া তরুণী অল্প সময়ের পরিচয়ে সহকর্মীকে কি এতটা ভরসা করতে পারেন? নির্মাতা সাবা ও তাঁর মায়ের সম্পর্ককে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে অন্যান্য চরিত্রের দিকে হয়তো একটু কম মনোযোগ দিয়েছেন।
‘সাবা’য় ঢাকা শহর এসেছে দারুণভাবে, যা মনে করিয়ে দেয় আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’কে। ‘সাবা’য় মোস্তফা মন্ওয়ার অভিনীত চরিত্রটি যেন সাদের সিনেমার ছাঁচেই গড়া। সেই সিনেমার মতো ‘সাবা’তেও ঢাকা নিয়ে তিনি নিজের বিরক্তি উগরে দেন। ছবিতে সাবার মাকে গোসল করানোর দৃশ্যটি রূপকভাবে ‘শেষ গোসল’ হিসেবে দেখানো হয়েছে, আজগর ফারহাদির ‘আ সেপারেশন’-এর কথা হয়তো আপনার মনে পড়বে। তবে প্রথম ছবিতেই মাকসুদ হোসাইন নিজের ছাপ রাখতে পেরেছেন; তাই চলতি বছর তো বটেই, ‘সাবা’ হয়তো গত কয়েক বছরের মধ্যে নির্মিত অন্যতম সেরা বাংলাদেশি সিনেমা।

পৃথা পারমিতা নাগ
ঢাকা