এরদোয়ান তো জিতলেন, উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের কী হবে

0
83
তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তুরস্কের দায়িত্বভার নেওয়ার সময় বক্তব্য দিচ্ছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। আঙ্কারা, ৩ জুন ২০২৩

টানা তৃতীয় মেয়াদে তুরস্কের শাসনভার হাতে নিলেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় দফায় গড়ানো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পেয়েছেন তিনি। টানটান উত্তেজনার সেই জয়ের পরপরই এরদোয়ানকে স্বাগত জানায় উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিল (জিসিসি)। এতে এই ইঙ্গিতই স্পষ্ট হয়েছে, সামনের দিনগুলোতে ছয় সদস্যদেশের জোটটির সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্কের পরিধি আরও বিস্তৃত হতে চলেছে।

কোনো রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিই প্রথম অভিনন্দন জানান এরদোয়ানকে। এরপর একে একে উপসাগরীয় নেতারা তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের আশা প্রকাশ করে এরদোয়ানকে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান।

৬৯ বছর বয়সী এরদোয়ান এরই মধ্যে দুই দশক তুরস্ক শাসন করেছেন। আরও পাঁচ বছর তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। তুরস্কের বিদেশনীতিতে জিসিসিভুক্ত সদস্যদেশগুলোর গুরুত্ব কতটা, তা তুলে ধরতে এরদোয়ান শিগগিরই এসব দেশ সফরে যাবেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, জিসিসিও আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে দুই পক্ষের মধ্যকার বাণিজ্যের ব্যাপ্তি বাড়ার আশা করছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, তুরস্কের ঘনিষ্ঠ মিত্র কাতার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও সম্প্রসারণ করবে বলেই মনে হয়। অন্যদিকে এটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে—সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদারে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আরও সচেষ্ট হবেন।

কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও রিয়াদভিত্তিক আরব নিউজের কলাম লেখক সিনেম সেনগিজ বলেন, গত দুই দশকে যেমনটা ছিল, তুরস্কের সঙ্গে উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্ক আগামী দিনেও হয়তো ব্যক্তিগত সম্পর্কের বৈশিষ্ট্যই পেতে যাচ্ছে। ফলে সে ক্ষেত্রে এরদোয়ানের আগামী পাঁচ বছর দুই পক্ষের মধ্যকার সহযোগিতার ব্যাপ্তি ব্যক্তিগত সম্পর্কেরই বর্ধিত রূপ হবে।

অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা

তুরস্ক আগামী দিনগুলোতে তার অর্থনীতি, রাজনীতি ও নিরাপত্তার দিকে অধিক মনোযোগী হবে। অন্যদিকে তুরস্কের সঙ্গে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও তাদের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম জিসিসিভুক্ত সম্পদশালী দেশগুলোর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে তুরস্কের অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের বিষয়টি এ দুই বড় অর্থনীতির জন্যই সুফল বয়ে আনবে। বড় অঙ্কের পারস্পরিক বিনিয়োগে লাভবান হবে উভয় দেশই।

আরেক দফায় এরদোয়ানের জয় নিশ্চিত হওয়ার কয়েক দিন পরেই আঙ্কারা ও আবুধাবি নিজেদের মধ্যকার সহযোগিতার ক্ষেত্র বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছে। সে অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরে তারা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চার হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বৈদেশিক বাণিজ্যবিষয়ক মন্ত্রী থানি আহমেদ আল–জেইউদি এক টুইটে বলেন, ‘এই চুক্তি আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের মধ্যে সহযোগিতার নতুন যুগে প্রবেশ।

প্রতিরক্ষা খাতে তুরস্কের হিস্যা বাড়ছে। বিশেষ করে তাদের বেরাকতার টিবি২ ড্রোনের চাহিদা রয়েছে
প্রতিরক্ষা খাতে তুরস্কের হিস্যা বাড়ছে। বিশেষ করে তাদের বেরাকতার টিবি২ ড্রোনের চাহিদা রয়েছে

এর আগে ২০২১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স শেখ মোহামেদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান আঙ্কারা সফর করেন। বিগত বছরগুলোর উত্তেজনা সরিয়ে নতুন করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত রচিত হয় তখন।

তুরস্কের সঙ্গে উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সম্পর্কের ব্যাপ্তি তাদের বহুমুখী অর্থনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর হাইড্রোকার্বনের ওপর নির্ভরতা কমাতে তুর্কি কোম্পানিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। উপসাগরীয় অঞ্চলে বিমানবন্দর থেকে মহাসড়ক, স্টেডিয়াম থেকে বহুতল ভবন—বড় বড় প্রকল্প নির্মাণে তুরস্কের নির্মাণ খাত বহু দিন থেকে বড় হিস্যা রেখে চলেছে। সম্প্রতি আঙ্কারায় সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল–গ্যাস কোম্পানি সৌদি আরামকোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন তুরস্কের প্রায় ৮০টি অবকাঠামো নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। সেখানে সৌদি আরবে পাঁচ হাজার কোটি ডলারের প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা হয়।

এ ছাড়া সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা খাতেও তুরস্কের ভূমিকা রাখার বড় সুযোগ তৈরি হতে পারে। লিবিয়ার গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাদেক ইনস্টিটিউটের বাতু কসকুন মনে করেন, সৌদি আরবের প্রতিরক্ষার কৌশলগত ২০৩০ সালের যে রূপকল্প, তাতে তুরস্কের সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাঁর কথায়, ‘এ ক্ষেত্রে যৌথভাবে উৎপাদন, প্রযুক্তি বিনিময় ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হতে পারে।’

সিরিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক

জিসিসির সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু সিরিয়া। ১১ বছর পর গত মাসে আরব লীগের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ ফিরে পেয়েছে দামেস্ক। এ পটভূমিতে প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরায় জোড়া দেওয়ার দিকে নজর দিচ্ছে আঙ্কারা।

তবে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের কুর্দি সশস্ত্র গোষ্ঠী পিপলস প্রটেকশন ইউনিটস (ওয়াইপিজি) নিয়ে আঙ্কারা ও দামেস্কের অবস্থান ভিন্ন। ফলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পথে ওয়াইপিজি ‘কাঁটা’ হয়ে উঠতে পারে। কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) শাখা ওয়াইপিজির প্রশ্নে নিরাপত্তা নিয়ে কিছু নিশ্চয়তা চাইবে তুরস্ক। কেননা, পিকেকে আঙ্কারাসহ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইউই) চোখে সন্ত্রাসী সংগঠন।

অন্যদিকে ওয়াইপিজি–নিয়ন্ত্রিত সিরিয়ার বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সশস্ত্র ও বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর জোট সিরীয় গণতান্ত্রিক শক্তিকে (এসডিএফ) মেনে নিতে বাশার সরকারকে নানাভাবে প্ররোচিত করছে রিয়াদ ও আবুধাবি। দেশ দুটির ভাষ্য, এর মাধ্যমে সিরিয়ার ঐক্য ধরে রাখা যাবে, দামেস্কের সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের (বাঁয়ে) সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। জেদ্দা, সৌদি আরব, ২৮ এপ্রিল ২০২২
সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের (বাঁয়ে) সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। জেদ্দা, সৌদি আরব, ২৮ এপ্রিল ২০২২

এই অর্থে উপসাগরীয় দেশগুলো, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ‘বিদ্যমান মস্কোর প্রভাব’কে আঙ্কারা–দামেস্ক আলোচনায় কাজে লাগাতে সচেষ্ট হতে পারে বলে মনে করেন সাদেক ইনস্টিটিউটের বাতু কসকুন। তাঁর মতে, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো সম্ভাব্য তুরস্ক–সিরিয়া সম্পর্ক কোনোভাবে আঙ্কারা–আবুধাবি সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে কি না। যুক্তরাষ্ট্র চায় না মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় তাদের মিত্র ও সহযোগীরা বাশার আল–আসাদকে বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিক। সুতরাং আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ার সরকারের সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্ক পুনঃস্থাপনকে ওয়াশিংটন স্বাগত জানাবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।

এ পটভূমিতে বাশারের সঙ্গে জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে তুরস্ক হয়তো কিছুটা লাভবান হতে পারে। কারণ, তারা প্রথম এই পথে পা বাড়াচ্ছে না। ফলে দামেস্কের সঙ্গে তাদের নতুন করে সম্পর্কে জড়ানোর বিষয়টি পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে কম বিতর্কিত হতে পারে।

বাতু কসকুনের কথায়, আঙ্কারা যুক্তিতর্ক তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এড়াতে সচেষ্ট হবে… অন্যদিকে বাশারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আঞ্চলিক ঐকমত্য পুনরায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উঠে আসবে।

সম্প্রীতি ও সম্পর্কের পুনর্নির্মাণ

এটা খুব বেশি আগের কথা নয় যে সৌদি আরব, এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাত তুরস্কের প্রশ্নে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করত না। আরব বসন্তের পর মিসর, লিবিয়া ও তিউনিসিয়ার সংকট নিরসনের প্রশ্নে স্বার্থের দ্বন্দ্বে মনোমালিন্যের সূত্রপাত। একই ঘটনা ঘটে কাতারকে একঘরে করার বিষয়ে। সব মিলিয়ে আঙ্কারা একদিকে চলে যায়, অন্যদিকে অবস্থান নেয় সৌদি আরব–সংযুক্ত আরব আমিরাত পক্ষ।

পরে ২০০০ সাল থেকে রিয়াদ ও আবুধাবির সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় উন্নতি ঘটতে শুরু করে। একই সময় থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কও বিবর্তিত হচ্ছে।

বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে কাজ করা ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গালফ ইন্টারন্যাশনাল ফোরামের নির্বাহী পরিচালক দানিয়া থাফের বলেন, এক যুগ আগে যখন আবর বসন্ত শুরু হয়েছিল, সে সময়ে নেওয়া অবস্থানের বিপরীতে এখন এরদোয়ান নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা শেখ তাহনাওন বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের (ডানে) সঙ্গে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। আঙ্কারা, তুরস্ক, ১৮ আগস্ট ২০২১
সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা শেখ তাহনাওন বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের (ডানে) সঙ্গে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। আঙ্কারা, তুরস্ক, ১৮ আগস্ট ২০২১

দানিয়া থাফের বলেন, মতাদর্শিক রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে বেশি মনোযোগী হওয়া জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর মতো এখন প্রায় অভিন্ন অবস্থানই নিয়েছে আঙ্কারা। সে অনুযায়ী এরদোয়ান তাঁর শেষ মেয়াদে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে সচেষ্ট থাকবেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ জিসিসিভুক্ত অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুরস্ক বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক একাধিক চুক্তি সই করবে বলেই ধারণা করা যায়।

দানিয়া থাফেরের কথায়, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়, তুরস্কের সঙ্গে আঞ্চলিক সম্পর্কের উন্নতি অঞ্চলটিতে ইরানের প্রভাবের বিপরীতে পাল্টা হিসেবে কাজ করবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.