চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খালি কনটেইনারে করে বিদেশ চলে যাওয়ার ঘটনা বারবার ঘটলেও দায় নিচ্ছে না কেউই। কার গাফিলতিতে এমন ঘটনা বারবার হচ্ছে, জানা যাচ্ছে না সেটিও। গত ১৩ বছরে এমন ঘটনা ঘটেছে ৯ বার। এমন চেষ্টা চালানো ১০ জনের মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। সাতজন জীবিত ফিরতে সক্ষম হয়েছেন। একই ঘটনার সর্বশেষ পুনরাবৃত্তি হয়েছে গত ১২ জানুয়ারি। তিন মাসের মধ্যে এটি দ্বিতীয় ঘটনা। তারপরও সর্বশেষ ঘটনা তদন্তে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বন্দর কর্তৃপক্ষ। আগের ঘটনাগুলোতে তদন্ত কমিটি হলেও শাস্তি দেওয়া হয়নি কাউকেই। কোথা থেকে কীভাবে বারবার খালি কনটেইনারে মানুষ উঠছে, সেটিও খুঁজে বের করতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ।
অথচ এমন ঘটনায় চট্টগ্রাম বন্দর ও বেসরকারি ১৯ আইসিডির দায় রয়েছে। কারণ যে কোনো খালি কনটেইনার জাহাজে তোলার আগে যাচাই করার কথা তিন ধাপে। বন্দরে নেওয়ার আগে প্রথমে তা খুলে যাচাই করার দায়িত্ব ডিপো কর্তৃপক্ষের। এরপর বন্দরের ফটক দিয়ে ঢোকার সময় দ্বিতীয়বার যাচাই করার কথা বন্দরের নিরাপত্তাকর্মীর। সর্বশেষ জাহাজে তোলার আগে ফের কনটেইনারের দরজা খুলে যাচাই করার কথা বন্দর কর্তৃপক্ষের। কিন্তু এই কাজটি যথাযথভাবে হচ্ছে না দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে মালয়েশিয়া থেকে এখনও আমাদের কেউ কিছু অবহিত করেনি। অভিযোগ পেলে আগের মতো এটিরও তদন্ত করব আমরা।’ আগের তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোথা থেকে এভাবে লোক উঠছে তা চিহ্নিত করা যায়নি। তারপরও কয়েকটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা বলতে পারছি না এখন।’ তবে শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ‘কনটেইনারে এভাবে লুকিয়ে মানুষ চলে যাওয়ার এমন ঘটনায় বন্দর ও বেসরকারি আইসিডির কেউই দায় এড়াতে পারেন না। কিন্তু কারও বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। অথচ এমন ঘটনায় দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বিদেশে।’
৯ বারের চেষ্টাতে বিদেশ চলে গেলেন ১০ জন: বাংলাদেশ থেকে কনটেইনারে লুকিয়ে বিদেশযাত্রার প্রথম ঘটনা ঘটে ২০১০ সালের ৮ জুন। সোয়েব রিপন নামে এক যুবক অবৈধভাবে বন্দরে ঢুকে ‘এমভি হ্যানসা ক্যালিডোনিয়া’ জাহাজে লুকিয়ে থাকেন। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর একজন নাবিক জাহাজে তাকে শনাক্ত করেন। পরে তাকে চট্টগ্রামে ফেরত আনা হয়। বিনা পাসপোর্টে বিদেশ ভ্রমণের অপরাধে তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর কনটেইনারে করে মালয়েশিয়ায় চলে যান ফল বিক্রেতা মো. রিপন। ২০১১ সালের ৯ এপ্রিল সিঙ্গাপুরে খালি একটি কনটেইনার থেকে উদ্ধার করা হয় দু’জনকে। এর মধ্যে দ্বীন ইসলামকে কঙ্কালসার অবস্থায় এবং আল আমিন নামের আরেক শ্রমিককে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। একই বছরের ২৬ এপ্রিল জাহাজে লুকিয়ে বিদেশে যাওয়ার সময় বরিশালের আকতার আলী নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে মামলা দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জাহাজে করে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার সময় ধরা পড়েন মো. রিপন নামে আরেক ব্যক্তি। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে বন্দর থানায় হস্তান্তর করা হয়। ২০১৬ সালের ১৯ অক্টোবর ভারতের বিশাখাপত্তম বন্দরে একটি খালি কনটেইনার থেকে রোহান হোসেন নামের এক বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে ভারতীয় পুলিশ। চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তাকর্মীরা ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই যুক্তরাজ্যগামী পোশাকের একটি কনটেইনার থেকে বাবুল ত্রিপুরা নামের এক শ্রমিককে উদ্ধার করেন। অক্টোবরে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি কনটেইনারে করে মালয়েশিয়া চলে যান। দীর্ঘদিন কনটেইনারের ভেতর অভুক্ত থাকায় তিনি মারা যান। মালয়েশিয়ার পুলিশ উদ্ধার করে তার মৃতদেহ। কিন্তু তিনি কোথা থেকে কখন কনটেইনারে ঢুকেছেন, তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। তিন মাসের মাথায় এবার একই প্রক্রিয়ায় বিদেশ গেছে এক কিশোর। মালয়েশিয়ার কেলাং সমুদ্রবন্দরে উদ্ধার হওয়া এই কিশোরের বয়স আনুমানিক ১২ থেকে ১৫ বছর। খালি কনটেইনারের ভেতর লুকিয়ে কেলাং বন্দরে পৌঁছায় সে ১৬ জানুয়ারি। কনটেইনারের ভেতর তার চিৎকার শুনে জাহাজটি কেলাং বন্দরে নোঙর করে মালেশিয়ান পুলিশকে খবর দেয়। তারা এসে কিশোরকে উদ্ধার করে ১৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার রাত ১০টায় জরুরি ভিত্তিতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। এখন হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। জাহাজটি গত ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি-১ জেটি থেকে মালেশিয়ার উদ্দ্যেশে রওনা দিয়েছিল।
বারবার একই ঘটনা, তবু দায় নেয় না কেউই: হংকং ভিত্তিক ‘এমবি ইন্টেগ্রা’ জাহাজেই ছিল এবারের কনটেইনারটি। এটির স্থানীয় শিপিং এজেন্ট চট্টগ্রামের কন্টিনেন্টাল ট্রেডার্স বিডি লিমিটেড। জানা গেছে নেমসন ডিপো থেকে খালি কনটেইনার নিয়ে জাহাজটি মালেশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এ জাহাজে রিলায়েন্স শিপিং এন্ড লজিস্টিকস লিমিটেডের ১০৫টি খালি কনটেইনার ছিল। এর একটিতে লুকিয়ে ছিল কিশোরটি। নেমসন কনটেইনার লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক কাজি মুরাদ হোসেন দাবি করেন বন্দর দিয়ে খালি কনটেইনার জাহাজে উঠানোর আগে তা দরজা খুলে ভালোভাবে যাছাই করা হয়েছে। ডিপো থেকে কনটেইনারের ভিতরে মানুষ উঠার সুযোগ নেই।
বন্দর ও ডিপোর পদে পদে নিরাপত্তা ত্রুটি: দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর ও ১৯ বেসরকারি আইসিডির প্রতিটিতেই আছে নিরাপত্তা ত্রুটি। বছরে সাড়ে ৩২ লাখ কনটেইনার উঠা নামা করা চট্টগ্রাম বন্দরে নেই পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরা। নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা রক্ষী। বাইরে থেকে ধার করে আনা আনসার সদস্য পালন করছে নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব। বন্দরের ১২টি গেটসহ গুরুত্বপূর্ণ ২০টি স্থানে স্ক্যানার দরকার হলেও আছে মাত্র ৭টি। রেডিওয়েক্টিভ পোর্টাল মনিটরও (আরপিএম) আছে চাহিদার এক তৃতীয়াংশ। সংকট আছে দক্ষ জনবলেরও। চট্টগ্রাম বন্দরে আসা পণ্য শুল্ক্কায়নের দায়িত্বে থাকে কাস্টমস। অথচ সেই কাস্টমসের সঙ্গেও বন্দরের আছে সমন্বয়হীনতা। এসব কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে মোট আমদানিকৃত পণ্যের মাত্র ১৪ শতাংশ এখন শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করতে পারছে কাস্টমস কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০২১ সালেও ১৫ লাখ একক রপ্তানি পণ্যভর্তি কনটেইনার বিদেশে গেছে স্ক্যানিং ছাড়াই। এর ফলে বিপজ্জনক, নিষিদ্ধ ও অবৈধ পণ্য রপ্তানির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। থেকে যাচ্ছে খালি কনটেইনারে ফের মানুষ চলে যাওয়ার ঝুঁকিও। অথচ বন্দরের নিরাপত্তা ঝুঁকি কমাতে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন প্রকল্পের আওতায় ২০০৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে পণ্য স্ক্যানিং বাধ্যতামূলক করা হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। কিন্তু উদ্যোগ নেয়ার এক যুগ পরও আমদানি ও রপ্তানি পণ্য শতভাগ স্ক্যানিং করা যাচ্ছে না। নিরাপত্তা ঝুঁকিও কমছে না দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের। একই অবস্থা বেসরকারি ডিপোগুলোতেও। সেগুলোও নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীন। যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে খালি কনটেইনার জাহাজে উঠানোর কথা সেটা যথাযথভাবে মানছে না ডিপো কর্তৃপক্ষ। তাদেরও নেই পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি। নেই দক্ষ জনবলও।