দেশের অর্থনীতি নানামুখী চাপে। ডলারের সংকট এখনো প্রকট। পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গেলে কোনো কোনো ব্যাংক ফিরিয়ে দিচ্ছে। আবার রপ্তানি আয় তুলতে গেলেও সহজে দিচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আর আগে ঘটেনি।
শুধু তা–ই নয়, চাল, ডাল, লবণ, ভোজ্যতেল, চিনিসহ প্রায় প্রতিটি জিনিসেরই দাম বাড়তি। চলতি অর্থবছরের জন্য সরকার মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। গত এপ্রিলে তা ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ দাঁড়িয়েছে সরকারি হিসাবেই। গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ও সারের দাম কয়েক মাস আগেই বাড়ানো হয়েছে। কমেছে ডলারের তুলনায় টাকার মান। প্রণোদনা দিয়েও প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) ওইভাবে টানতে পারছে না সরকার। রপ্তানি আয়ের প্রবণতাও কমতির দিকে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। গত এপ্রিলে এসে সরকার দেখল এ ঋণে কুলোবে না। ফলে ব্যাংকঋণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা করা হয় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা।
আর আছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নানা ধরনের শর্ত পূরণের চাপ। আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার চেয়ে সরকার প্রথম কিস্তি মাত্র পেয়েছে। দ্বিতীয় কিস্তি পেতে সময় লাগবে আগামী ডিসেম্বর। তা–ও শর্ত পূরণ করতে পারলেই পাওয়া যাবে সে কিস্তি। রিজার্ভ সংরক্ষণসহ বড় কিছু শর্ত পূরণ না হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
তবে খরচ করতেই হচ্ছে সরকারকে। এ জন্য ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ করছে বেশি। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। গত এপ্রিলে এসে সরকার দেখল এ ঋণে কুলোবে না। ফলে ব্যাংকঋণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা করা হয় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা।hfuct
কারওয়ান বাজারে গতকাল বুধবার দুপুরে কাঁচাবাজার করতে আসা ফজলুল হক নামের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কাছে বাজেটে প্রত্যাশা জানতে চাইলে বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম কি কমবে? যদি না কমে, এ বাজেট নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই।’
এত সব টানাপোড়েন ও বাস্তবতা মাথায় নিয়েই আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি তাঁর পঞ্চম বাজেট। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য তিনি যে বাজেট বক্তব্য দেবেন, তার নাম দিয়েছেন ‘উন্নয়নের দীর্ঘ অগ্রযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নেই। শোনা যাচ্ছে অর্থমন্ত্রী শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। ফলে অনেক অনুষ্ঠানেই তিনি আর এখন থাকেন না। ফলে দীর্ঘ সময় পরই বাজেট উপস্থাপনার জন্য অর্থমন্ত্রীকে আজ প্রকাশ্যে আসতে হচ্ছে।
বাজেট নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় যা বলছে
অর্থ মন্ত্রণালয় গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের মূল দর্শন হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ। বাজেটটি হবে এ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে প্রথম বাজেট। গত দেড় দশকে বর্তমান সরকারের তত্ত্বাবধানে দেশের অর্জনগুলো একটি টেকসই ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করে দিয়েছে। আর স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সমাজ এবং স্মার্ট অর্থনীতি—এ চার মূল স্তম্ভের ওপর।
এবারের বাজেটে সংগত কারণেই স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বলেছে, অর্থবছরের পুরো সময়জুড়েই থাকবে সরকারের নানা ধরনের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো হচ্ছে।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটের আকার হচ্ছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। আর অনুদানসহ আগামী অর্থবছরের জন্য আয় হিসাব করা হচ্ছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৮৫ কোটি টাকা।
আয় বৃদ্ধির প্রধান উৎস এনবিআর। অথচ চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৩৪ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছে। ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৮ দশমিক ৮ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল করা, আয়বৈষম্য রোধ করা এবং রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি করা—এগুলো হচ্ছে আগামী বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। অর্থমন্ত্রী এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কী সব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সেটাই হচ্ছে দেখার বিষয়।
মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, বেশি ব্যাংকঋণ নিয়ে সরকার মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। এ ঋণ কমাতে হবে। আর ডলারের দাম স্থিতিশীল করতে হবে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ করে বেশি নজর দিতে হবে। দুই হাজার টাকা করে ন্যূনতম কর নেওয়ার পরিবর্তে বরং নতুন নতুন করদাতার কাছ থেকে কর আদায় করতে হবে। আর আয়বৈষম্য রোধ ও দরিদ্রদের পাশে দাঁড়াতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতা বাড়াতে হবে।
এক লাখ কোটি টাকা কীভাবে বাড়বে
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয় ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সংশোধিত আকারকে ভিত্তি ধরলে আগামী বাজেটের আকার বাড়ছে ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। কিন্তু এ বৃদ্ধির বাস্তবভিত্তিক কোনো কৌশল নিয়ে অর্থমন্ত্রীর কোনো ঘোষণা থাকছে না বলে জানা গেছে।
আগামী বাজেটে অবশ্য ৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আয় আসবে বলে সরকার ধরে নিচ্ছে। এ আয়ের মধ্যে ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হচ্ছে কর। করের মধ্যে এনবিআর নিয়ন্ত্রিত অংশ ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ও এনবিআর–বহির্ভূত অংশ ২০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া কর–বহির্ভূত প্রাপ্তি ৫০ হাজার কোটি টাকা ও অনুদান ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
আয় বৃদ্ধির প্রধান উৎস এনবিআর। অথচ চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৩৪ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছে। ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য ধরা হলেও গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে সব মিলিয়ে ২ লাখ ৫০ হাজার ২৮২ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে।
টাকা ছাপানো কি বাড়বে?
আগামী বাজেটের ঘাটতি থাকছে অনুদান ছাড়া ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। ঘাটতি পূরণ (অর্থসংস্থান) করা হবে দুইভাবে—বৈদেশিক ঋণ ও অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে। বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে নিট ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, আর সঞ্চয়পত্র বিক্রিসহ ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার তুলনায় আগামী অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার ২৬ হাজার বা ২৪ শতাংশ বেশি ঋণ নেবে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, বেশি ব্যাংকঋণ মানে বেশি টাকা ছাপানো। আর বেশি টাকা ছাপানো মানে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কা। সরকার বেশি ব্যাংকঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি।
আইএমএফ বলেছে, আগামী সাড়ে তিন বছর ধরে স্বাভাবিক গতির চেয়ে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহ করতে হবে। আর সেই কৌশল প্রণয়ন করতে হবে এই জুনের মধ্যে।
আইএমএফের শর্ত পূরণ
আগামী বাজেটে আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়ার শর্ত পূরণের প্রতিফলন থাকছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে আইএমএফের কথা উল্লেখ না করেই সংস্থাটির দেওয়া শর্তগুলোর বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করার ঘোষণা থাকবে। থাকবে কিছু সংস্কারের ঘোষণাও।
আইএমএফ বলেছে, আগামী সাড়ে তিন বছর ধরে স্বাভাবিক গতির চেয়ে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহ করতে হবে। আর সেই কৌশল প্রণয়ন করতে হবে এই জুনের মধ্যে। এনবিআরকে শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিটও করতে হবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে। আয় বৃদ্ধির জন্য ৬০ হাজার ইলেকট্রনিক ফিশক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) কেনার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে আগামী অর্থবছরে। ভ্যাট বিভাগের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনার পাশাপাশি নতুন ৫টি ভ্যাট কমিশনারেটও তৈরি করবে এনবিআর। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রণয়ন করতে হবে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের সময়ভিত্তিক সূত্র।
যেসব পরিবর্তন আসতে পারে
আগামী বাজেটে বেশির ভাগ আয়কর রিটার্ন জমাকারীকে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আসছে। সঞ্চয়পত্র কেনা, ক্রেডিট কার্ড নেওয়াসহ ৪৪ ধরনের সেবা নিতে আয়কর রিটার্ন জমার রসিদ লাগবে।
ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকায় উন্নীত করার ঘোষণাও থাকতে পারে। জমি-ফ্ল্যাট কেনাসহ বাড়তে পারে ৫০ ধরনের মাশুল। এ ছাড়া ভ্রমণ কর বাড়তে পারে।
সিগারেট, কলম, প্লাস্টিকের টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, টিস্যু, ন্যাপকিন, দেশীয় কোম্পানির মুঠোফোন উৎপাদন পর্যায়ে বাড়তি শুল্ক-কর আরোপ হতে পারে। দ্বিতীয় গাড়ি কিনলে কার্বন করের মতো বাড়তি কর দিতে হতে পারে। বর্তমান তিন কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে করের ওপর সারচার্জ দিতে হয়। এই সম্পদের সীমা বাড়িয়ে চার কোটি টাকা করা হতে পারে।
এবার প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে সর্বজনীন পেনশন চালুর ঘোষণা দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বাজেট নিয়ে বলেন, একদিকে নির্বাচনী বছর, আরেকদিকে অর্থনীতিতে অনেক নেতিবাচক দিক। ব্যয় যেভাবে বাড়ছে, আয় সেভাবে নয়। আয় করতেই হবে, কিন্তু সে বাস্তবতা কম। ফলে এবারের মতো বহুমুখী চ্যালেঞ্জ পরিস্থিতি দেখা গেছে কমই।