‘কখনো কখনো হতাশার উল্টো পিঠেই আশীর্বাদের দেখা পাবে’

0
166
র‍্যানডাল পার্ক

র‍্যানডাল পার্ক একজন মার্কিন অভিনেতা, কমেডিয়ান ও লেখক। ১৬ জুন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেসের সমাবর্তনে বক্তা ছিলেন তিনি। র‍্যানডাল এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র।

র‍্যানডাল পার্ক

আমার নাম র‍্যানডাল পার্ক। পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে যেমনটা বলা হলো—আমি খুবই সফল একজন অভিনেতা। আমি অত্যন্ত মেধাবী, বুদ্ধিমান ও বিনয়ী; বেশ সুদর্শনও। এসব কথা আসলে তোমাদের না, নিজেকেই শোনাচ্ছি। কারণ, কদিন আগে যখন আমাকে সমাবর্তন বক্তা হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো, প্রথমেই মাথায় এসেছিল—আমি কেন? আমার চেয়ে সফল, গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক মানুষ তো আছেন। তাই শুরুতে নিজেই নিজেকে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার ভালোবাসার স্ত্রী ও সন্তানকে, যারা আজ এখানে উপস্থিত আছে। স্মরণ করতে চাই আমার মা-বাবাকে, যাঁরা আমাদের মাঝে নেই। না, না, মা-বাবা বেঁচে আছেন। এ অনুষ্ঠানেও ছিলেন, কিন্তু সম্ভবত আমার বক্তৃতা শুরু হতে না হতেই তাঁরা বিরক্ত হয়ে বের হয়ে গেছেন।

মজা করলাম। তাঁরা এখনো আছেন।

আজ কথা বলব হতাশা নিয়ে। হতাশা এমন এক ‘চরিত্র’, যা ঘুরেফিরে সারা জীবনই চলার পথে তোমার সঙ্গে থাকবে। হয় তুমি হতাশাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারো, জীবনটাকে আরও তিক্ত করতে পারো; নয়তো এ থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও শক্তিশালী, বুদ্ধিমান, সহানুভূতিশীল, অনুপ্রাণিত হতে পারো। কখনো কখনো হতাশার উল্টো পিঠেই আশীর্বাদের দেখা পাবে। এ প্রসঙ্গেই আজ আমার জীবনের তিনটি গল্প বলব।

প্রথম গল্প

আমি মনেপ্রাণে অভিনেতাই হতে চেয়েছিলাম। যখন চেষ্টা শুরু করলাম, প্রথম এক দশক শুধু ব্যর্থতাই দেখে গেছি। বয়স ৩০ পেরোনোর পরও মা-বাবার সঙ্গে থাকতাম। পকেটে টাকা ছিল না। মনে তীব্র হতাশা। প্রেম-জীবনের অবস্থাও ছিল যাচ্ছেতাই। ৩২ বছর বয়সী একজন বেকার অভিনেতার সঙ্গে কেউ প্রেম করতে চাইত না। কিন্তু ২০১৩ সালে একটা সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে গেলাম। নাম দ্য ইন্টারভিউ। আর আমার চরিত্রটা ছিল উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং–উনের।

একজন সত্যিকার একনায়কের চরিত্রে অভিনয় করা কতটুকু বুদ্ধিমানের কাজ হবে, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। পরে ভাবলাম, ‘এখন যে অবস্থায় আছি, এর চেয়ে খারাপ আর কীই–বা হতে পারে। অন্তত মানুষকে দেখানোর সুযোগ তো পাব, আমি কী পারি।’

ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই আমার চরিত্রটির কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে গেল। এমনকি স্টুডিওর প্রধান আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘এই ছবি তোমার জীবন বদলে দেবে।’ আমি আরও আত্মবিশ্বাস পেলাম। জান দিয়ে কাজ করতে থাকলাম। প্রথমবারের মতো একটা টিভি সিরিজের যাচাইপর্বে (পাইলট) কাজ করার প্রস্তাবও চলে এল।

তারপর কী হয়েছিল, তোমাদের অনেকের হয়তো মনে আছে। ছবি মুক্তির কিছুদিন আগে উত্তর কোরিয়া হুমকি দিয়ে বসল, কোনো থিয়েটার দ্য ইন্টারভিউ দেখালেই সন্ত্রাসী হামলা করা হবে। সনি স্টুডিওজের অভ্যন্তরীণ সিস্টেম হ্যাক হয়ে গেল। স্টুডিও আমার ছোট্ট বাড়ির সামনে নিরাপত্তারক্ষী বসানোর ব্যবস্থা করল। বড় বড় থিয়েটার দ্য ইন্টারভিউ নামিয়ে ফেলল। আমার বড় সাফল্যের স্বপ্ন অচিরেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল, তা–ও সত্যিকার কিম জং–উনের তৎপরতায়!

যদিও ছবিটি অনলাইনে আর কিছু ছোটখাটো থিয়েটারে চলেছিল, কিন্তু ছবির চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘ছবি ঘিরে বিতর্ক’। ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু ধুলা ঝেড়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছি।

তারপরই ঘটল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এত কিছুর মধ্যে যে ‘ছোট্ট’ টিভি সিরিজটিতে অভিনয় করব বলে সম্মত হয়েছিলাম, সেটাই বিশাল নাম করে ফেলল। ফ্রেশ অব দ্য বোট নামের সেই টিভি সিরিজ এবিসির অন্যতম জনপ্রিয় সৃষ্টি। এরই মধ্যে একে একে ৬ সিজন পেরিয়ে গেছে। শোটি শুধু আমার জীবন নয়, আমার ধারণা, পুরো ইন্ডাস্ট্রিই বদলে দিয়েছে। কিন্তু দ্য ইন্টারভিউতে সুযোগ না পেলে ফ্রেশ অব দ্য বোট-ও আমার জীবনে কখনোই আসত না।

দ্বিতীয় গল্প

আমার সৌভাগ্য, মার্ভেল ইউনিভার্সে আমি এজেন্ট জেমি য়ু চরিত্রে অভিনয় করতে পেরেছি। ২০২১ সালে মার্ভেল স্টুডিওজের প্রথম ওয়েব সিরিজ ওয়ান্ডা ভিশন প্রচারিত হয় ডিজনি প্লাসে, জেমি য়ু ছিল সেই সিরিজের অংশ। সিরিজটি এতই জনপ্রিয়তা পায় এবং আমার চরিত্রটি লোকে এতই পছন্দ করে যে গত বছর মার্ভেল লেজেন্ড জেমি য়ুর একটি খেলনাও (অ্যাকশন ফিগার) বাজারে ছাড়ে। খেলনাটা হুবহু দেখতে আমারই মতো। আমি সব সময় ভাবতাম, আমার অ্যাকশন ফিগার দেখতে কেমন হতে পারে! সেই স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেল।

কিছুদিন আগে বেস্ট বাইতে গিয়েছি। দেখলাম, দেয়ালজুড়ে জেমি য়ুর অ্যাকশন ফিগার, ক্লিয়ারেন্স সেল—এসব কম দামে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। গল্পটা এখানেই শেষ। সব গল্পের মধুরেণ সমাপয়েৎ হয় না।

শেষ গল্প

২০০৮ সালে আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর নারীটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তার নাম জে। আমি তাকে ডেটে আমন্ত্রণ জানাই। কোন আক্কেলে কে জানে, সে হ্যাঁ বলে দেয়। এক বছর পর আমি তাকে আমাকে বিয়ে করার আমন্ত্রণ জানাই। তখনো কেন কে জানে সে হ্যাঁ বলে দেয়। ২০১১ সালে জানতে পারি, আমি বাবা হতে যাচ্ছি। সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। আমার চাওয়া ছিল একটাই—একটি সুস্থ–সবল শিশু। তবে মনের খুব গভীরে অবশ্য আমি একটা মেয়েশিশু চাইছিলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল, মেয়ের বাবা হিসেবে আমি যতটা ভালো হতে পারব, ছেলের বাবা হিসেবে ততটা পারব না। যদি কখনো ফুটবল মাঠে আমাকে দেখে থাকো, বুঝতে পারবে কেন এ কথা বলছি।

২০১২ সালের ১৭ মে স্বপ্নটা পূরণ হলো, জন্ম নিল অপূর্ব সুন্দর, স্বাস্থ্যবান এক কন্যাশিশু। যদিও মায়ের পেট থেকে রুবির বেরিয়ে আসার দৃশ্যটা আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলোর একটি। এতই ভয় পেয়েছিলাম যে চিৎকার করে বলছিলাম, ‘ওকে ভেতরেই থাকতে দাও!’ ভাগ্যিস, চিকিৎসকেরা আমার কথা শোনেননি। যেই মুহূর্তে ছোট্ট শিশুটিকে আমার কোলে তুলে দেওয়া হলো, আমি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম।

রুবি ঠিকঠাকই বড় হচ্ছিল। কিন্তু একটা সময় লক্ষ করলাম, সে ওর বয়সী আর দশটা বাচ্চার মতো নয়। সে খুব দ্রুত মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। কিছু শব্দ বা পরিবেশ ওকে খুব অস্বস্তি দেয়। স্কুলে বন্ধু বানানোর প্রতি ওর কোনো আগ্রহ ছিল না। কারণ, অন্যরা যখন দিব্যি গল্পগুজব করছিল, রুবির কথাবার্তা সীমাবদ্ধ ছিল স্রেফ দু–এক শব্দে।

আমরা চিকিৎসকের কাছে গেলাম। মাসের পর মাস নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানানো হলো, রুবি অটিজমে আক্রান্ত। ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। প্রথম প্রতিক্রিয়াই ছিল—কীভাবে আমরা এটা ‘ঠিক’ করব। এই জটিল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর পৃথিবীর জন্য কীভাবে আমরা ওকে তৈরি করব? আমি পাগলের মতো নানা বিষয়ে পড়ালেখা শুরু করলাম—থেরাপি, ডায়েট, ওষুধ, আধুনিক প্রযুক্তি। তথ্য, ভুল তথ্য, আর কুতর্কের সাগরে রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমি আসলে একরকম ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম। ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

আজ রুবির বয়স ১১ বছর। সে এখনো অটিজমে আক্রান্ত। কিন্তু তাতে কিছুই বদলায়নি। সে মায়ের মতো অপূর্ব সুন্দর, শক্তিশালী। বাবার মতো নিরীহ। সে সৃজনশীল, রসবোধসম্পন্ন, হাসতে ভালোবাসে। সে আমাদের গর্ব, আমাদের আনন্দ। রুবি আমাকে সহানুভূতি শিখিয়েছে। শিখিয়েছে, যোগাযোগ মানে শুধু শব্দের ব্যবহার নয়। কাজে, আচরণে, পাশে থেকে, সময় দিয়ে, এমনকি কিছু না বলেও নিঃশর্ত ভালোবাসা প্রকাশ করা যায়।

আমি ভাবতাম, ওকে আমি কীভাবে সুস্থ করব। কিন্তু এখন বুঝি, রুবিকে নয়, পৃথিবীটাকে সুস্থ করা দরকার।

(সংক্ষেপিত)

অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.