বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বাড়িভাড়া খাতে দুর্নীতি, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কোষাধ্যক্ষ ছাড়াই বেআইনিভাবে তহবিল পরিচালনাসহ নানা রকম অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে ২৭ বছরের পুরোনো বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির বিষয়ে বিভিন্ন রকমের ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
কয়েক দিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব নির্দেশ দিয়েছে। ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল ইউজিসি। এখন তারই আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়টির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে।
সংকট সঙ্গে করেই চালু হচ্ছে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়
জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, এখন যে বিষয়গুলো ইউজিসির এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে সে বিষয়ে ইউজিসি ব্যবস্থা নেবে। বাকি বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার এ কে এম এনামুল হক বলেন, ইতিমধ্যে কিছু বিষয় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো হয়েছে, শিক্ষকের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। আর কিছু বিষয়ে আরও পরিষ্কার হওয়া দরকার। সে জন্য ইউজিসির সঙ্গে সভা করার জন্য সময় চাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে। তাঁদের চাওয়া অনুযায়ী ইতিমধ্যে কিছু কাগজপত্র দেওয়া জমা দেওয়া হয়েছে। সেখানেই বেরিয়ে আসবে কোনটা সত্য, আর কোনটি মিথ্যা।
মান নিয়ে প্রশ্ন, তবু নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির বাড়িভাড়া খাতে বড় ধরনের দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। ক্যাম্পাস না থাকা সত্ত্বেও ক্যাম্পাস দেখিয়ে ভাড়া হিসেবে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় ব্যক্তি নামে ফ্ল্যাট কেনা, ট্রাস্টের অনুকূলে বাড়িভাড়া পরিশোধসহ প্রতিটি লেনদেনই সন্দেহজনক ও আইনবহির্ভূত।
তাই এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে ইউজিসিকে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষ জঙ্গিবাদ ও সরকারবিরোধী কার্যক্রমে অর্থায়নে সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন দিতেও বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো এক নির্দেশনাপত্রে মোট আট ধরনের ব্যবস্থা নিতে বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সূচনালগ্ন থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আচার্য ও রাষ্ট্রপতির নিয়োগ করা কোষাধ্যক্ষ ছিল না। এ জন্য আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিল পরিচালনা করা হয়নি। সে জন্য ২০১০ (সংশোধিত আইন পাসের সময়) সাল থেকে এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টির সব আয়-ব্যয় বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত বহির্নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলোর (সিএ ফার্ম) মধ্যে থেকে সরকার মনোনীত একটি ফার্ম দিয়ে পুনরায় নিরীক্ষা করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ পুনর্গঠন ও পুনরায় নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন না হওয়া বা ইউজিসির পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুধু শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং জরুরি একাডেমিক ব্যয় ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে অন্য কোনো খাতে ব্যয়, বিনিয়োগ বা তহবিল স্থানান্তর করতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়টির সব বিভাগে পূর্ণকালীন কমপক্ষে একজন করে অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগসহ সব বিভাগে আগামী তিন মাসের মধ্যে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করে ইউজিসি ও মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাপত্রে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়টির যেসব শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে অন্যায়ভাবে জোরপূর্বক ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, তাঁদের সসম্মানে স্বপদে বহাল এবং সাবেক উপাচার্য আবুল হাসান মোহাম্মদ সাদেক অবৈধভাবে পদ থেকে যেসব কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন, তা বাতিল করতে হবে। এ ছাড়া তিনি বেতন-ভাতাসহ যেসব সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলে অবিলম্বে ফেরত দিতে হবে।
মাত্র দুটি বিভাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্ট ডিড ও ট্রাস্টের মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশনের বিধানগুলো আইনের পরিপন্থী হওয়ায় আইনবিরুদ্ধ বিধান বাদ দিয়ে দ্রুত নতুন ‘মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন’ প্রণয়নের ব্যবস্থা নিতে বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এ ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনানুযায়ী নিয়মিত সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সভা আহ্বান ও পরিচালনা করা, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য চাকরির প্রবিধানমালা ও বেতনকাঠামো প্রণয়ন করে ইউজিসির অনুমোদন নিতে হবে।
শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে কিছু ক্ষেত্রে নমনীয়তাও দেখিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির সাময়িক সনদের মেয়াদ শেষ হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনানুযায়ী সনদপত্রের জন্য আবেদন জমা না দেওয়ায় বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রমের আইনগত কোনো বৈধতা নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়টি চালু রাখার জন্য আইনের শর্তগুলো অবিলম্বে পূরণ করে সাময়িক অনুমতির মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করতে হবে। এতে ব্যর্থ হলে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।