এখনও স্প্লিন্টারের ব্যথা হয়

0
170
গ্রেনেড হামলার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মশিউর রহমান হুমায়ুন

‘সেদিন নিজে প্রাণে বেঁচে ফিরবো ভাবিনি। প্রিয় নেত্রীকে বাঁচাতে পারবো ভাবিনি। আমরা অনেকেই সেদিন মানব ঢাল হয়ে নিজেদের শরীরে স্প্লিন্টার গ্রহণ করেছি। কিন্তু নেত্রীকে রক্ষার চেষ্টা করেছি। নিজেরা স্প্লিন্টারে ক্ষতবিক্ষত হলেও পরম শান্ত্বনা নেত্রীকে রক্ষা করতে পেরেছিলাম। সবগুলো স্প্লিন্টার বের করা সম্ভব হয়নি। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এখনও অনেক স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়ে আছে। সময়ে সময়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করি।’

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের আড়াইবাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা কৃষিবিদ মশিউর রহমান হুমায়ুন একান্ত সাক্ষাৎকারে এভাবেই বর্ণনা করছিলেন সেই ভয়াল ২১ আগস্টের নারকীয় গ্রেনেড হামলার স্মৃতি।

প্রশ্ন: প্রথমে মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ হবার কথা ছিল। সেটি বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে কেন গেল?

হুমায়ুন: তৎকালীন বিএনপি-জামায়েত সরকার কারসাজি করে আমাদের বাধ্য করেছিল মুক্তাঙ্গনের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সমাবেশ করতে। কারণ সেই এলাকাটি ছিল জঙ্গিদের জন্য কৌশলগতভাবে নিরাপদ ও উপযোগী।

প্রশ্ন: গ্রেনেড হামলার সময় আপনি কোথায় অবস্থান করছিলেন?

হুমায়ুন: আমাদের নেত্রী একটি ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছিলেন। এসময় দলের প্রথম সারির নেতারা অনেকেই ট্রাকের ওপর ছিলেন। আমিসহ আরও অনেকেই অস্থায়ী মঞ্চের চারপাশে ছিলাম। নেত্রীর বক্তৃতার মাঝখানে বিকট শব্দে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতে লাগলো। মঞ্চের আশেপাশে অনেকগুলো গ্রেনেড পড়লো। অনেকেই ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছিলেন। আইভী রহমানসহ অনেকেই রক্তাক্ত জখম হয়েছিলেন। পুরো এলাকায় আর্তচিৎকার। আমিসহ অনেক নেতাই তখন নেত্রীকে ঘিরে ধরে নিশ্চিদ্র মানব ঢাল তৈরি করে দাঁড়ালাম। নেত্রীকে বাঁচানোর জন্য আমরা নিজেদের জীবনকে কবুল করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত নেত্রীর গায়ে একটি স্প্লিন্টারের আঘাতও লাগতে দেইনি।

প্রশ্ন: আপনার শরীরের কোথায় কোথায় স্প্লিন্টার ঢুকেছিল।

হুমায়ুন: আমার দুই উরু, মুখমণ্ডল, বুকসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলো স্প্লিন্টার ঢুকেছিল। রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। কিন্তু নেত্রীকে নিরাপদে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করার পর আমাকে প্রথমে নেয়া হলো বারডেমে। সেখান থেকে নেয়া হলো মগবাজারের শমরিতা হাসপাতালে। সেখানে আহত অবস্থায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং সাবের হোসেন চৌধুরীসহ আরও বেশ কয়েকজনকে নেয়া হয়েছিল।

প্রশ্ন: আপনি কাকে এই হামলার জন্য দায়ী করেন?

হুমায়ুন: অবশ্যই তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারকে। এই পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তারেক জিয়া, প্রতিমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবররা।

প্রশ্ন: কেন এটা মনে হচ্ছে?

হুমায়ুন: সারাজাতি শুনেছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এই গ্রেনেড নাকি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়া হামলার পরপরই পুরো এলাকার ছোপ ছোপ রক্ত ধুয়ে পরিস্কার করে ফেলা হলো। ঘটনাস্থলে পাওয়া গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আলামত নষ্ট করে ফেলা হলো। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বন্দী ছিলেন। কারাগারের ভেতরও গ্রেনেড পাওয়া গেছে। সেগুলিও নষ্ট করে ফেলা হলো। হামলাকারীদের সরকারি নিরাপত্তায় বিদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা হয়েছিল। এছাড়া তদন্ত কাজে বাধা সৃষ্টি করা, জজ মিয়া নাটক সাজানো, সবকিছুতেই এটা স্পষ্ট যে, এই হামলা সরসরি তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের পরিকল্পনায় হয়েছিল।

প্রশ্ন: এই হামলার তো বিচার হয়েছে। আপনি কি তাতে খুশি?

হুমানায়ুন : রায়ে আমি খুশি হলেও রায় এখনও কার্যকর হয়নি। আমি রায়ের দ্রুত বাস্তবায়ন চাই। যেসব জঙ্গি বিদেশে পালিয়ে গেছে, তাদেরকেও দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি করছি।

প্রশ্ন: কেন এতবড় হামলা ঘটানো হলো?

হুমায়ুন: এটিকে কেবল ‘২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা’ হিসেবে দেখার অবকাশ নেই। এটা ছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ধারাবাহিকতা। বিএনপি-জামায়াত চেয়েছিল ১৫ আগস্টের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে। তারা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে। সেই পরিকল্পনা থেকেই এই নারকীয় হামলা চালানো হয়েছিল।

প্রশ্ন: আপনি কবে থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হলেন?

হুমায়ুন: ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হলেন। পরের বছর ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে আমাকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী করা হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.