এক লাখের ঋণ পেতে ঘুষ লাগে ৩০ হাজার

0
144

ডালিম মল্লিক ও রুবিনা খাতুন দম্পতি। বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পশ্চিম আব্দালপুর ইউনিয়নের চড়পাড়া গ্রামে। ডালিম পেশায় ক্ষুদ্র কৃষক। পানের বরজ ও পশু পালন করে সংসার চলে তাঁর। কৃষি ব্যাংক কুষ্টিয়া বঙ্গবন্ধু মার্কেট শাখায় ক্ষুদ্র কৃষি ঋণের জন্য আবেদন করেন গত রোজার ঈদের আগে। গরু পালনসহ কৃষি কাজের জন্য এ ঋণের জন্য আবেদন করলেও তা পেতে তাঁকে ঘুরতে হয় বেশ কয়েক মাস। ২ লাখ টাকা ঋণের আবেদন করলেও শেষ পর্যন্ত দেনদরবার করে গত বছরের শেষ দিকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পান তিনি। এ টাকা পেতে কৃষি ব্যাংকের মাঠ কর্মকর্তাকে দিতে হয়েছে ২০ হাজার টাকারও বেশি।

এ দম্পতির মতো শত শত কৃষক কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তাদের দুর্নীতির জালে বন্দি। দালাল ও টাকা না হলে কোনো লোন পাস হয় না কৃষি ব্যাংকের কোনো শাখায়। প্রতিটি ইউনিয়নে কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাতজন করে দালাল আছে কর্মকর্তাদের। এসব দালাল লোনের জন্য কৃষকদের সঙ্গে দেনদরবার করে। যাঁদের লোনের প্রয়োজন নেই, এমনকি মাঠে এক কাঠা জমিও নেই, তাঁদের নামেও লোন পাস হচ্ছে অহরহ। কুষ্টিয়া অঞ্চলের সব কৃষি ব্যাংকের একই চিত্র। বেশ কয়েক সপ্তাহ সরেজমিন মাঠ পর্যায়ে ঘুরে ভুক্তভোগী, দালাল, ইউপি মেম্বার আর চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা হলে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়।
কৃষি ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতি খুঁজতে সদরে তিনটি ইউনিয়নের দুটির প্রায় পাঁচটি গ্রাম ছাড়াও দৌলতপুর, মিরপুর ও কুমারখালী উপজেলায় খোঁজ নেওয়া হয়। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হচ্ছে কৃষি ব্যাংক বঙ্গবন্ধু মাকের্ট শাখায়। এ শাখা থেকে সদরের প্রায় ছয় থেকে সাতটি ইউনিয়নে ঋণ দেওয়া হয় কৃষকদের।

কৃষকরা জানান, মাঠ পর্যায়ে কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তাদের দুর্নীতির জাল পাতা রয়েছে। জমি আছে ও সচ্ছল কৃষকরা আবেদন করলে নানা প্যাঁচ লাগিয়ে দেওয়া হয়। পরে নানা মারপ্যাঁচে ফেলে কৃষকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন কর্মকর্তারা। প্রতিটি কেসের জন্য টাকা গুনতে হয় কৃষকদের। রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট।

কৃষি ব্যাংক বঙ্গবন্ধু মার্কেট শাখার কৃষি কর্মকর্তা সোয়েব আল সাবা। তিনি মাস খানেক আগেও আব্দালপুর ইউনিয়নের দায়িত্বে ছিলেন। এখন পাশের আলামপুর ইউনিয়নে কাজ করছেন। সব মিলিয়ে এখানে প্রায় পাঁচ বছর চাকরি করছেন। তাঁর মাধ্যমে গত কয়েক বছরে এলাকার দুই শতাধিক কৃষক কৃষি লোন নিয়েছেন। এর পাশাপাশি সিসি লোনও নিয়েছে অনেক পরিবার। সোয়েব আল সাবার বিরুদ্ধে কৃষক, ইউপি মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের নানা অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটি লোন পেতে তাঁকে লাখে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। সাবার নিয়ন্ত্রণে শুধু আব্দালপুর ইউনিয়নে দালাল রয়েছে পাঁচ থেকে সাতজন। এর মধ্যে দেড়িপাড়া গ্রামের জাহাঙ্গীর, আব্দালপুরের মানোয়ার ও বিষুষ্ণদিয়া গ্রামের মাহবুব হোসেন।
আব্দালপুরে রুবিনা ও ডালিমের বাড়িতে কথা হলে তাঁরা বলেন, লোনের আবেদন করার পর অনেক দিন ঘুরতে হয়েছে ব্যাংকে। পরে ২০ হাজার টাকা দাবি করেন সাবা। সেই টাকা লোন পাওয়ার পর শহর থেকে নেন। আমাদের রক্ত চুষে খাচ্ছেন তাঁরা, তাঁদের পাতা জালেই কৃষকরা বন্দি। বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।

পশ্চিম আব্দালপুর ইউনিয়নের দরগাপাড়া গ্রামের আসাদুল ইসলাম। সচ্ছল কৃষক, ২০১৭ সালে প্রথম কৃষি লোন নেন ২ লাখ টাকা। ২০২১ সালে এসে পরিশোধ করে নতুন করে লোনের জন্য আবেদন করেন। সাত একর জমির কাগজপত্র দাখিল করার পর ফের ২ লাখ টাকা লোন নিয়েছেন। এ লোন পেতে সাবাকে ২৪ হাজার টাকা দিতে হয়। গোপালপুর গ্রামের জহুরা খাতুনকে লোন দেওয়ার কথা বলে তাঁর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেন ওই কর্মকর্তা। তবে লোন হয়নি জহুরা খাতুনের। পরে এনজিও থেকে চড়া সুদে লোন নেন তিনি।
মধুপুর গ্রামের সিএনজি অটোরিকশা চালক সাবার মাধ্যমে ঋণের আবেদন করেন। ২ লাখ টাকার জন্য সাবা তাঁর কাছে ৬০ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে ৫৬ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন আব্দালপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার বশির উদ্দিন।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, গত তিন বছরে এলাকার শত শত কৃষককে লোনের জালে বন্দি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সাবা। পাঁচ বছরের চাকরিতে তিনি এখন কোটি টাকার মালিক।
অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে কৃষি ব্যাংক বঙ্গবন্ধু মার্কেট শাখায় গেলে সোয়েব আল সাবা এ প্রতিনিধির দিকে তেড়ে আসেন। তিনি বলেন, আপনার সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারব না। কোনো তথ্য দিতে পারব না। আপনি তথ্য জানার কে? পরে বিভিন্নজনকে দিয়ে নিউজ বন্ধ করার তদবির করেন তিনি।

একইভাবে কৃষি ব্যাংক আইলচারা শাখা, ত্রিমহোনী শাখা, কুমারখালী বাজার শাখা, মধুপুর শাখায়ও লোন পেতে দালাল ধরে আসতে হয়। ব্যাংক ঘিরে এভাবেই গড়ে উঠেছে দালাল চক্র।
জেলার কুমারখালী শাখায়ও আছে দালালদের শক্ত সিন্ডিকেট। কৃষি ব্যাংক কুমারখালী শাখার পিয়ন আমিরুল ইসলাম। তাঁর নিজের বাড়ি যদুবয়রা ইউনিয়নে। নিজেই ব্যাংকের দালালি করেন তিনি। তাঁর মাধ্যমে আসা কৃষকদের লোন করে দেন তিনি। এ জন্য তিনি চুক্তি অনুযায়ী অর্থ নেন বলে জানান কৃষকরা।

আমিরুল বলেন, অনেকে লোনের ব্যাপারে সাহায্য নেওয়ার জন্য আসেন। আমরা নানাভাবে তাঁদের সাহায্য করে থাকি। এখানে লোন দিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা।
কৃষি ব্যাংক কুষ্টিয়া বিভাগীয় কার্যালয় থেকে কুষ্টিয়াসহ পাঁচ জেলা তদারকি করা হয়। এখানকার এজিএম দেবাশীষ ঘোষ বলেন, মাঠ পর্যায়ে লোন দেওয়ার দায়িত্ব থাকে স্ব-স্ব শাখার। আমাদের কাজ তদারকি করা। আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ এলে সে অনুযায়ী খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। তবে কৃষকদের হয়রানি করার কোনো সুযোগ নেই।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.