এক বিলিয়ন ইয়ান অর্থনৈতিক সহযোগিতার ঘোষণা চীনের

0
75
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বুধবার বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে স্বাগত জানান চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ছবি: পিআইডি

বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ইয়ান অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে চীন। গতকাল বুধবার সকালে বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে এ সহযোগিতা দেওয়ার ঘোষণা দেন চীনের প্রধানমন্ত্রী। এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে উন্নয়নের দিকে বাংলাদেশের অভিযাত্রায় তাঁর অব্যাহত সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

বৈঠক শেষে বেইজিংয়ে সাংবাদিকদের এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, চীনের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ইয়ান অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেওয়ার ঘোষণা করেছেন। চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে তারা মূল্য দেন। বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এ সময়ে চীনের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে আরও পণ্য আমদানির কথা বলেছেন।

গতকালের বিনিময় মূল্য অনুযায়ী, এক বিলিয়ন ইয়ানে প্রায় ১৪ কোটি ডলার। এর আগে ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টে শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের ২৭টি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এতে সরকারের সঙ্গে প্রায় ২৫-২৭ বিলিয়ন বা ২৫০০-২৭০০ কোটি ডলারের মতো অনুদান, ঋণ এবং বেসরকারি খাতে আরও কিছু সমঝোতার আওতায় সব মিলিয়ে ৪০ বিলিয়ন বা চার হাজার কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি এসেছিল। তা থেকে এখন পর্যন্ত আট বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। শি জিনপিংয়ের সেই সফরে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্ব পর্যায়ে উন্নীত হয়।

বাসস জানায়, গতকাল বাংলাদেশ ও চীন উভয় দেশ বিদ্যমান ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ থেকে ‘বিস্তৃত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বে’ উন্নীত হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে ২২ সমঝোতা স্মারক ও দলিল সই হয়েছে। সাত ঘোষণাপত্রও সই হয়। সই হওয়া দলিলের মধ্যে দুটি নবায়ন। বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের উপস্থিতিতে ২১ দলিল সই হয়। পরে বেইজিংয়ের সেন্ট রেজিস হোটেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের উপস্থিতিতে ২২তম সমঝোতা স্মারক সই হয়।

এর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সকালে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের জন্য গ্রেট হল অব দ্য পিপলে পৌঁছলে তাঁকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ সময় চীনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান। পরে প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
স্বাগত অনুষ্ঠানের পর গ্রেট হল অব দ্য পিপলে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সম্মানে গ্রেট হলে আয়োজিত চীনের রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যু, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে আলোচনা হয়।

দুই দেশের গণমাধ্যমের সই হওয়া ৬ দলিল

প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের গণমাধ্যমের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ছে। এবারের সফরে দুই দেশের গণমাধ্যমের মধ্যে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক ও একটি দলিল সই হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে– চীনের জাতীয় বেতার ও টেলিভিশন প্রশাসন এবং বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর সই, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি) এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতাবিষয়ক স্মারক সই, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি) এবং বিটিভির মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই, সিনহুয়া নিউজ এজেন্সি ও বিটিভির মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই, চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া ও বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদ সংস্থা-বাসসের মধ্যে স্মারক সই এবং আরেকটি দলিল সই করে সিনহুয়া সংবাদ সংস্থা ও বাংলাদেশ টেলিভিশন।

সই হওয়া বাকি দলিলগুলো হচ্ছে

ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদার করার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক; চায়না ন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রেগুলেটরি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনএফআরএ) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে ব্যাংকিং ও বীমা নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশ থেকে চীনে তাজা আম রপ্তানির জন্য উদ্ভিদ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত উপকরণ বিষয়ে প্রটোকল, অর্থনৈতিক উন্নয়ন নীতি-সহায়তা ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহায়তা বিষয়ে সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশে প্রকল্পে চায়না-এইড ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের ‘সম্ভাব্যতা সমীক্ষা’ বিষয়ে আলোচনার সাইনিং অব মিনিটস (কার্যবিবরণী) সই, চীনের সহায়তায় ষষ্ঠ বাংলাদেশ-চায়না মৈত্রী সেতু সংস্কার প্রকল্পের চিঠি বিনিময়, নাটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা পার্ক প্রকল্পে চায়না-এইড কনস্ট্রাকশনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা বিষয়ে চিঠি বিনিময়, চীনের সহায়তায় নবম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু প্রকল্প বিষয়ে চিঠি বিনিময়, মেডিকেল সেবা ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সহযোগিতা শক্তিশালী করতে সমঝোতা স্মারক, অবকাঠামোগত সহযোগিতা জোরদারে সমঝোতা স্মারক, গ্রিন অ্যান্ড লো-কার্বন উন্নয়ন বিষয়ে সহযোগিতা বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক, বন্যার মৌসুমে ইয়ালুজাংবু (ব্রহ্মপুত্র) নদীর হাইড্রোলজিক্যাল তথ্য বাংলাদেশকে দেওয়ার বিধিবিষয়ক সমঝোতা স্মারক নবায়ন, চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়।

সই হওয়া ৭ ঘোষণাপত্র 

চীন-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সমাপ্তি ঘোষণা; চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি ত্বরান্বিতকরণ নিয়ে আলোচনা শুরুর ঘোষণা; ডিজিটাল কানেক্টিভিটি প্রকল্পের জন্য টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের আধুনিকীকরণের সমাপ্তির ঘোষণা; ডাবল পাইপ লাইন প্রকল্পের সঙ্গে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ের ট্রায়াল রান সমাপ্তির ঘোষণা; রাজশাহী ওয়াসা সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট চালুর ঘোষণা; শানদং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুরের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং বাংলাদেশে লুবান ওয়ার্কশপ নির্মাণের ঘোষণাপত্র সই।

এদিকে, গতকাল রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সুবিধার প্যাকেজ ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দৃঢ় সহায়তা দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। বুধবার বিকেলে বেইজিংয়ের গ্রেট হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশকে সহায়তা, সুদমুক্ত ঋণ, ছাড়যুক্ত ঋণ ও বাণিজ্যিক ঋণ– এই চার ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধার একটি প্যাকেজ দেওয়ার ঘোষণা দেন। চীন থেকে একটি কারিগরি কমিটি শিগগির বাংলাদেশ সফর করবে।

বৈঠক শেষে হাছান মাহমুদ বেইজিংয়ের সেন্ট রেজিস হোটেলে প্রেস ব্রিফিং করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট নিজে থেকেই বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলেন। তিনি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে এবং প্রয়োজনে আরাকান সেনাদলের সঙ্গেও কথা বলবেন বলে জানান।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই চীন সফর শতভাগ সফল হয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট বৈঠকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নকে অভূতপূর্ব বর্ণনা করেন এবং চীনা সহায়তা অব্যাহত থাকবে বলে জানান। শি জিনপিং বলেন, ২০২৫ সালে চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে সম্পর্ককে দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত করে এ উদযাপনকে অর্থবহ করতে তারা প্রস্তুত।

গত কয়েক দশকে চীনের অভূতপূর্ব উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীন আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি অনুপ্রেরণা।

চীনের প্রেসিডেন্ট ‘সুশাসনের জন্য ভালো দল প্রয়োজন’ মন্তব্য করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যোগাযোগ বৃদ্ধি ও বন্ধনের ওপর জোর দেন। পাশাপাশি শি জিনপিং বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, কারিগরি, কৃষি ও উৎপাদন খাতে সহায়তা এবং ছাত্রবৃত্তি বৃদ্ধির আশ্বাস দেন।

চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের আনোয়ারায় দেশটির জন্য একক বরাদ্দ ৮০০ একর জমিসহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও আইটি ভিলেজগুলোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ থেকে পাট ও চামড়াজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, সিরামিক, আম, অন্যান্য ফলসহ পণ্য আমদানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার আহ্বান জানালে চীনের প্রেসিডেন্ট ইতিবাচক সাড়া দেন বলে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সফরের এক দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং ত্যাগ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ বেশি অসুস্থ হওয়ার কারণে চীন সফরের সব অনুষ্ঠান অপরিবর্তিত রেখে শুধু ১১ তারিখ সকালের পরিবর্তে ১০ জুলাই রাতে বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.