কোনো ব্যক্তির অনলাইনে একাধিক জন্মনিবন্ধন থাকলে প্রথমটি রেখে বাকিগুলো বাতিল করার নিয়ম ছিল। এই নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
নতুন নিয়ম অনুসারে, ব্যক্তি তাঁর সুবিধামতো একটি জন্মসনদ রেখে বাকিগুলো বাতিল করতে পারবেন। এ জন্য তাঁকে আলাদা করে অনলাইনে আবেদন করতে হবে।
নতুন এই নিয়ম জানিয়ে ৫ জুলাই সারা দেশের নিবন্ধন কার্যালয় ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) কাছে চিঠি পাঠিয়েছে ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’।
তবে নতুন নিয়ম কার্যকর হলেও এখন পর্যন্ত একাধিক জন্মসনদ বাতিলে তেমন সাড়া নেই। তা ছাড়া জন্মনিবন্ধন নিয়ে ঘন ঘন নতুন সিদ্ধান্ত আসায় সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা নতুন নিয়ম সম্পর্কে অবগত নন বলে জানা গেছে।
নতুন নিয়ম নিয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় যে চিঠিটি ইস্যু করেছে, তার শিরোনাম ‘জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সনদ বাতিলের অনুমোদন প্রক্রিয়া’।
চিঠিতে বলা হয়েছে, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সফটওয়্যার বিডিআরআইএসে অপ্রয়োজনীয় সনদ বাতিলের সুবিধা (অপশন) চালু করা হয়েছে। এই সুবিধার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি তাঁর অব্যবহৃত ও অপ্রয়োজনীয় জন্মসনদগুলো বাতিল করে নিতে পারেন।
নতুন নিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে গত বৃহস্পতিবার রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান বলেন, একাধিক জন্মসনদধারী ব্যক্তি এখন তাঁর জন্য যে সনদটি প্রয়োজনীয় মনে করবেন, সেটি রেখে বাকিগুলো বাতিল করতে পারবেন।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, অনলাইনে একাধিক জন্মনিবন্ধন থাকলে প্রথমটি রেখে বাকিগুলো বাতিল করার আগের নিয়মে অনেকে বিপাকে পড়ছিলেন। বিশেষ করে, যাঁরা জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টে প্রথমটির পরিবর্তে দ্বিতীয় বা তৃতীয় জন্মসনদের নম্বর ব্যবহার করেছিলেন, তাঁরা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিলেন। কারণ, তখন জন্মসনদের সঙ্গে তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্টের তথ্যের গরমিল হয়ে যাচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে একাধিক জন্মসনদ বাতিলের নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
যে পদ্ধতিতে বাতিল করতে হবে
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের ইস্যু করা চিঠিতে একাধিক জন্মসনদ বাতিলের পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একাধিক জন্ম সনদধারী ব্যক্তি তাঁর বাতিলযোগ্য সনদসহ সংশ্লিষ্ট নিবন্ধক কার্যালয়ে হাজির হবেন।
এখানে ‘সংশ্লিষ্ট নিবন্ধক কার্যালয়’ বলতে যেখানে ব্যক্তি নিবন্ধন করে তাঁর জন্মসনদ নিয়েছিলেন, সেই স্থানকে বোঝানো হয়েছে।
পরবর্তী প্রক্রিয়া হলো সংশ্লিষ্ট নিবন্ধক ব্যক্তির জন্মসনদগুলো অনলাইনে যাচাই করবেন। তিনি তাঁর অনুমোদিত ইউজার আইডি থেকে নির্ধারিত ফি নিয়ে অনলাইনে জন্মসনদ বাতিল আবেদনের কাজ শেষ করবেন।
পরে নিবন্ধক আবেদনটির বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য অনলাইন সিস্টেমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে পাঠাবেন। তিনি (রেজিস্ট্রার জেনারেল) তাঁর ইউজার আইডি থেকে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই শেষে বাতিলযোগ্য মূল জন্মসনদগুলো বাতিল করবেন। এর মধ্য দিয়ে আবেদনের নিষ্পত্তি হবে।
নতুন নিয়মে তেমন সাড়া নেই
কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন নিয়মে একাধিক জন্মসনদ বাতিলে এখনো তেমন একটা সাড়া পাননি নিবন্ধকেরা। কয়েকজন নিবন্ধক বলেছেন, নতুন নিয়মের বিষয়ে তাঁরা এখনো জানেন না।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫-এর সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এস এম ওয়াসিমুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেন, তাঁর কার্যালয়ে পুরোনো নিয়মেই একাধিক জন্মসনদ বাতিলের আবেদন নেওয়া হচ্ছে।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার ২ নম্বর বাকিলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, নতুন নিয়মের বিষয়ে তিনি অবগত নন।
২ নম্বর বাকিলা ইউপির হিসাব সহকারী মো. নাসির হোসেন জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের স্থানীয় আবেদনগুলোর বিষয়ে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বৃহস্পতিবার বলেন, ১০ থেকে ১২ দিন আগে তিনি নতুন নিয়মটির বিষয়ে জানতে পেরেছেন। তবে এলাকার কেউ তখন পর্যন্ত নতুন নিয়মে আবেদন করেননি।
হাজীগঞ্জ উপজেলার ১ নম্বর রাজারগাঁও (উত্তর) ইউপির চেয়ারম্যান মো. আবদুল হাদী মিয়া বৃহস্পতিবার বলেন, একাধিক জন্মসনদ বাতিলের ক্ষেত্রে নতুন নিয়মের বিষয়ে তিনিও কিছু জানেন না। তাঁর এলাকায় একাধিক জন্মসনদ বাতিল চেয়ে কেউ আবেদন করেননি।
হাজীগঞ্জের ইউএনও মো. রাশেদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেন, নতুন নিয়মটির বিষয়ে তিনি জানেন না। তবে একাধিক জন্মসনদধারী ব্যক্তির একটি সনদ রেখে বাকিগুলো বাতিলের কাজ আগে থেকেই চলছে। এই এলাকায় প্রবাসীর সংখ্যা বেশি। বিদেশ যাওয়ার সময় অনেকে না বুঝে একাধিক সনদ নিয়েছিলেন।
নতুন নিয়মে তেমন সাড়া না পাওয়ার বিষয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেল রাশেদুল হাসান বৃহস্পতিবার বলেন, চিঠি দিয়ে নিবন্ধক কার্যালয়গুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিবন্ধকেরা যাতে নতুন নিয়মের তথ্য প্রচার করেন, সে বিষয়টি দেখা হবে।
সার্ভার ‘ডাউনের’ অভিযোগ
বিভিন্ন স্থানে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের সার্ভার ‘ডাউন’ থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
চার দিন ‘ডাউন’ থাকার পর বৃহস্পতিবার থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫-এ জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ স্বাভাবিক হয় বলে জানা যায়।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার ২ নম্বর বাকিলা ইউপির হিসাব সহকারী নাসির হোসেন বৃহস্পতিবার বলেন, সার্ভার ‘ডাউন’ থাকায় জন্মনিবন্ধনের আবেদন নেওয়া গেলেও তা প্রিন্ট করা যাচ্ছিল না।
একই অভিযোগ করেন হাজীগঞ্জ উপজেলার ১ নম্বর রাজারগাঁও (উত্তর) ইউপির চেয়ারম্যান মো. আবদুল হাদী মিয়া। তিনি বৃহস্পতিবার বলেন, তিন থেকে চার দিন ধরে তাঁর এলাকায় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ বন্ধ রয়েছে।
ইউএনও রাশেদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেন, মাঝেমধ্যে সার্ভারের ‘আপ-ডাউন’ থাকে। তবে কাজ কখনো একেবারে থেমে থাকে না।
জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার জেনারেল রাশেদুল হাসান বলেন, সারা দেশে সার্ভার ডাউন নেই। মাঝেমধ্যে কিছু কাজ ব্যবস্থাপনার জন্য সামান্য সময়ের জন্য সার্ভার বন্ধ করে আবার তা খুলে দেওয়া হয়। সে সময় হয়তো অনেকে চেষ্টা করে সার্ভার পান না। আবার অনেক এলাকায় দক্ষতার অভাব, অমনোযোগিতার কারণে ইউপি কার্যালয়গুলো নিবন্ধনের কাজ ঠিকমতো করতে পারছে না। যে কাজ ইউপি চেয়ারম্যান ও সচিবের করার কথা, তা উদ্যোক্তাকে দিয়ে করানো হচ্ছে। অনেক সময় তাঁরা কার্যালয়ে অনুপস্থিত থাকেন। তখন লোকজন এলে ‘সার্ভার ডাউন’ বলে দায়িত্ব এড়ানো হয়।
অনিয়মের অভিযোগে ব্যবস্থা
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের দুটি ওয়ার্ডের সংশ্লিষ্ট নিবন্ধক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগে তাঁদের ইউজার আইডি বন্ধ রেখেছে রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়। ফলে সেখানে কিছুদিন ধরে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার জেনারেল রাশেদুল হাসান বৃহস্পতিবার বলেন, নারায়ণগঞ্জের তিনটি এলাকায় বিকল্প নিবন্ধক নিয়োগ দিয়ে কাজ আবার শুরু করা হবে।
‘ভোগান্তি যেন না হয়’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম গত শুক্রবার বলেন, জনসংখ্যার সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নে জন্ম, মৃত্যু ও স্থানান্তর—নাগরিকের এই তথ্যগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেশে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন চালুর ১২ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো সব মানুষকে নিবন্ধনের আওতায় আনা যায়নি। এখনো অর্ধেক শিশু নিবন্ধনের বাইরে। বারবার নিয়ম পরিবর্তন হলে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। নাগরিকেরা ভোগান্তি ছাড়াই যেন সহজে সেবাটি পায়, তা দেখতে হবে। সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া উচিত। একটি শিশু জন্ম নেওয়ার পর হাসপাতাল থেকেই যেন তথ্য নিবন্ধক কার্যালয়গুলোয় পৌঁছে যায়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। জন্মনিবন্ধন নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে অনিয়ম যেন না হয়, তার জন্য পর্যবেক্ষণব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।