একাত্তরে তালাবন্দী ঘরে ঘুমিয়ে থাকা সেই শিশুটি

0
191
কল্পনা মজুমদার (বিন্দা)। একাত্তরের এপ্রিলে মিলিটারির ভয়ে ভুলে তাঁকে শিশু অবস্থায় তালাবন্দী করে চলে গিয়েছিলেন স্বজনেরা। পরে অবশ্য তাঁকে উদ্ধার করা হয়। সম্প্রতি রাজশাহীতে তাঁর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়

তাপস মজুমদার যুদ্ধদিনের সেই স্মৃতিকথা নিয়ে লিখেছেন ‘কাহিনি যুদ্ধের নয় জীবনের’ নামের একটি বই। তাপসের বইয়ের শুরুতে লেখা, ‘ঠিক সে সময় মায়ের মনে নরকনৃত্য ও অগ্নিবিদ্যুৎ খেলে যাওয়ার সঠিক খবর, শুধু জগতের মায়েরাই বলতে পারেন। আমার সাধ্য কী তার বর্ণনা করি।’

এবার বিজয়ের মাসে একাত্তরের সেই শিশু কল্পনা বেড়াতে এসেছিলেন রাজশাহীতে। সেদিনের কোনো স্মৃতি তাঁর মনে না থাকলেও একাত্তরের কথা উঠলেই তিনি অন্য রকম হয়ে যান। একাত্তরের সেই স্মৃতির বর্ণনা আছে তাপসের লেখা বইয়ে।

সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তাপস লিখেছেন, ‘উনুনে ভাতের হাঁড়ি। কাঠের জ্বাল জ্বলছে। খালইয়ের মধ্যে রাখা কোটা-ধোয়া মাছ রান্নার অপেক্ষায়। উঠোনে মাড়াই করা ছোলা, মসুর, গম রোদে দেওয়া। শ খানেক কবুতরের প্রাঙ্গণজুড়ে বিক্ষিপ্ত বিচরণ। আউড়ভরা ধান। বস্তাভরা চাল লাট দেওয়া ভাঁড়ার ঘরে। মা ছিলেন রান্নাঘরে। বাবা উদ্ভ্রান্তের™মতো ছুটে এসে মাকে বললেন, কোথায় ছেলেমেয়েরা সব? চলো ওই দিকে।’

বাবার পরিচয় ও তৎকালীন অবস্থা বর্ণনা করে তাপস লেখেন, ‘টুকটুকে ফরসা দুধে আলতা মেশানো গায়ের মানুষটি খুব শৌখিন, রুচিশীল। ১৯৪৭ সালে কলকাতার ইছাপুর বন্দুক কারখানার কাজ ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন। গ্রামের বাড়িতে। আর ফিরে যাননি। ভালোই চলছিল সব। জমিজমা, গ্রামের নেতৃত্ব, সালিস, মাঝেমধ্যে নাটক, পুকুরে মাছ, গোলায় ধান, হাজারো বাঁশের ঝাড়, আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, গোয়ালে গরু, সংসার-সন্তান।’

তাপস সেদিনের বর্ণনা দিয়ে বলতে থাকেন, ‘আজ যখন উত্তরপাড়া থেকে ফেরার পথে বাবার খালি গায়ে লুঙ্গির ওপর কোমরে বাঁধা একটি গামছায় দরদর করে ঘাম ঝরছে, প্রখর রোদ আর ঊর্ধ্বশ্বাস আতঙ্কে তাঁর মুখ-শরীর রক্তলাল। তখন অতিচেনা মানুষটিকে চিনতে পারছিলাম না। আমার মনে আছে, তিনি যখন বলছেন, ওই দিকে চলো, তখন যে ঠিক কোন দিকে যাওয়ার কথা বলছেন তা বুঝে নেওয়ার উপায় নেই। আজও আমি বাবার কান্নাজড়ানো অসহায় কণ্ঠ শুনতে পাই—হিমালয় ভেঙে পড়ছে আচম্বিতে; গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে গলা ফাটিয়ে আমার বাবা নিঃশব্দে বলছেন, যাও, বাবা যাও। অথচ তিনি জানেন না, ঠিক কোথায় যেতে বলছেন।’

ভাই তাপস মজুমদারের সঙ্গে কল্পনা মজুমদার। যুদ্ধদিনের সেই স্মৃতিকথা নিয়ে তাপস লিখেছেন ‘কাহিনি যুদ্ধের নয় জীবনের’ নামের একটি বই। সম্প্রতি রাজশাহীতে

ভাই তাপস মজুমদারের সঙ্গে কল্পনা মজুমদার। যুদ্ধদিনের সেই স্মৃতিকথা নিয়ে তাপস লিখেছেন ‘কাহিনি যুদ্ধের নয় জীবনের’ নামের একটি বই। সম্প্রতি রাজশাহীতে

‘বাড়ি থেকে শেষ বেরোনোর আগে একবার গোয়ালে গেলেন মা। গরুগুলোর কপালে আলতো করে হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। পশুরাও কত বোঝে! দুটো গাইয়ের চোখে জল; গড়িয়ে পড়ছে। মা গলায় শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে কী যেন বললেন নিঃশব্দে। সুরেনদা (বাড়ির কাজের লোক) তাঁর কাঁধে করে জিনিসপত্র নিয়ে আমাদের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। রেডিও, বিছানার চাদর, কাঁথা, চিড়ে গুড় মুড়ি…।’

‘বাড়ি থেকে বের হয়ে অনেকটা দূর উত্তরপাড়া পার হয়ে মাঠে নেমেছি। মাঠের মধ্যে যখন সবাই মোটামুটি কাছাকাছি হয়েছে, তখন মা সুরেনদাকে জিজ্ঞেস করলেন, বিন্দা কার কাছে? বড় ছেলে গৌর মজুমদারের কোলে দিয়ে মা রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। গৌর তখন বললেন, ও কোলে ঘুমিয়ে গিয়েছিল তাই ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলাম। বাড়ির কাজের লোক সুরেন সেই ঘরে তালা দিয়ে এসেছেন। মা যাচ্ছিলেন ছুটে। কিন্তু তখন তাঁরা অনেক দূরে চলে এসেছেন। তাই সুরেন চাবি নিয়ে গেলেন। ঘর খুলে বিন্দাকে উদ্ধার করে আনেন।’

রাজশাহী নগরের চৌদ্দপাই এলাকায় তাপস মজুমদারের বাসা। সেই বাসায় বসে কথা হয় কল্পনা মজুমদার ওরফে বিন্দার সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘সেদিনের কোনো কথা তো কিছু মনে নেই। তবে এখন ভাবলে ভয় হয়, এমন তো হতে পারত, সেই গ্রামে গোলাগুলি শুরু হয়েছে, সুরেনদা আর যেতে পারেননি বা মিলিটারিরা গ্রামটি জ্বালিয়ে দিয়েছে। অনেক জায়গায় তো এমনটি হয়েছে।’

মা মায়া রানীর বয়স এখন ৮৩ বছর। মুঠোফোনে কথা হলো। বললেন, ‘বিন্দাকে আমি বড় ছেলের কোলে দিয়ে রান্নাঘরে কাজ করছিলাম। ভেবেছিলাম বিন্দা ওর কোলেই আছে…।’ আর বলতে পারলেন না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.