এই ‘সভারেন্টি’ হামলাকারীরা কাদের ‘রেন্ট’ করা?

0
8
‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’র কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মশাল মিছিল।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজধানী ঢাকায় কোনো নাগরিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে এভাবে কাউকে রক্তাক্ত হতে দেখা গিয়েছে কি? বলছিলাম অনন্ত বিকাশ ধামাইয়ের কথা। তাঁর গোটা চেহারা রক্তে ভেসে গেছে।

ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অ্যাকটিভিস্ট রফিক আমিনের পোস্ট করা ভিডিও দেখে বোঝাই যাচ্ছে অনন্ত বিকাশকে নৃশংসভাবে পেটানো হয়েছে। তিনিসহ আরও কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছেন। যাঁদের অধিকাংশ পাহাড়–সমতলের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণী। যে বিষয়টি উল্লেখ না করলেই নয়, তাঁদের ওপর হামলা করা হয়েছে, ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’ নামে একটি ‘বিতর্কিত’ জাতিবাদী স্লোগান দিয়ে।

পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দসংবলিত গ্রাফিতি রাখা না–রাখা নিয়ে দুই পক্ষের বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল আজকে। এক পক্ষ ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন। যারা কয়েক দিন আগে গ্রাফিতিটি বাদ দেওয়ার দাবিতে রাজধানীর মতিঝিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ভবনে ঢুকে পড়েছিল।

ফেসবুকে ছড়ানো ভিডিওতে দেখা যায়, বেশ ‘মারমুখী’ হয়ে এনসিটিবি ভবনে ঢুকে পড়েছিল তারা। তাদের হুমকি–ধমকির পরিপ্রেক্ষিতে একটি পাঠ্যপুস্তকের পেছনের প্রচ্ছদে থাকা গ্রাফিতিটি বইয়ের অনলাইন সংস্করণ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

নাগরিক সমাজে এই প্রশ্নটাই তখন জোরালো হয় যে কিছু শিক্ষার্থী বা ব্যক্তির একটি গোষ্ঠী গিয়ে হুমকি–ধমকি করল আর পাঠ্যপুস্তকও পরিবর্তন হয়ে গেল!

কিছুদিন আগপর্যন্ত খুব একটা নামধাম শোনা না যাওয়া ছোট একটা সংগঠনের কী এমন শক্তি যে, তাদের হুমকিধমকির মুখে পাঠ্যপুস্তকের মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পর্যন্ত পরিবর্তন এসে যায়? তার মানে কি শক্তি প্রদর্শন করে যে যার মতো এভাবে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করে ফেলতে পারবে? আর রাষ্ট্র বা সরকারও তা মেনে নেবে?

‘আদিবাসী’ শব্দ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা, মত ও বিতর্ক আছে। সেটি এ লেখার বিষয়বস্তু না। এখন ওই গ্রাফিতি বাদ দেওয়ায় পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীদের ছাত্র-যুব সমাজের একটি অংশ ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’ প্ল্যাটফর্মে আজকে এনসিটিবি ভবন ঘেরাওর কর্মসূচি দেয়।

বেলা ১১টার দিকে রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশ পালন করে তারা এনসিটিবি ভবনের দিকে রওনা দেয়। মতিঝিল মেট্রোরেল স্টেশন এলাকায় গিয়ে তারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেখানে অবস্থান করছিল স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি। দুই পক্ষের মাঝখানে ছিল পুলিশ।

দুই পক্ষ যার যার স্লোগান দিচ্ছিল। সামনে এগোতে না পেরে সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র–জনতার বিক্ষোভকারীরা অনেকে রাস্তায় বসে পড়ে। তখন আচমকা তাদের একজনের ওপর হামলা চালিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেয় স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টির কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের কয়েকজন।

প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্রলীগ ও সেই মুক্তিযোদ্ধার মঞ্চের মতো এই স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টিও ছাড় পেয়ে যাবে কি না? আর কারা এই স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি? পুলিশের সামনে কোন সাহসে বা ক্ষমতাবলে এভাবে একটি পক্ষের কর্মসূচিতে বাধা দেয় ও হামলা চালায়? পুলিশ কেন তাদের বাধা দিল না বা আক্রান্তদের বাঁচানোর চেষ্টা করল না?

তখন সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র–জনতার একজন নেতা বক্তব্য দিয়ে জানান, তারা আজকে আর এগোবে না। বাধা প্রদান ও হামলার প্রতিবাদে বরং তারা ১৭ জানুয়ারি আবারও কর্মসূচি পালন করবে। সেই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হবে, সেটিও উল্লেখ করেন তিনি। সেই বক্তব্যের পর তাঁদের ওপর এবার একযোগে হামলা চালানো হয়। তখন দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হলেও বেধড়ক মারধর খেয়ে এদিক–সেদিক ছিটকে পড়ে সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র–জনতার লোকজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শৈলী আখন্দ ও রফিক আমিনের বক্তব্য থেকে হামলার সূত্রপাতের বিষয়টি এভাবে জানা গেল। সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংহতি জানাতে সেখানে ছিলেন তাঁরা।

হামলায় আহত শৈলী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে যেতে মুঠোফোনে বলেন, ‘শুরুতে পুলিশ দুই পক্ষের মাঝখানে থাকলেও একপর্যায়ে তারা পুলিশ এদিক–সেদিক ছড়িয়ে–ছিটিয়ে যায়। সে সময় আমাদের ওপর হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা ছিল প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক। আমার মাথা ধরে রিকশার চাকার সঙ্গে আঘাত করতে নিয়ে যায়। সে সময় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা হকারদের চিল্লাফাল্লায় তারা আমাকে ছেড়ে দিলে ততক্ষণে রিকশার চাকায় লেগে আমার ঠোঁট ছিঁড়ে যায় এবং দাঁতে আঘাত লাগে। টানাহেঁচড়া করায় হাঁটুর ছিলে যায়। তারা লাঠি ও স্টাম্প দিয়ে আমাদের ওপর আঘাত করে। আমার গায়েও একটা বাড়ি লাগে। তখন আমার কয়েক হাত দূরে একজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে ছিল।’

ফেসবুকে স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টিরই ছড়ানো ছবি। যেখানে দেখা যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মটির কর্মীরা জাতীয় পতাকা বাঁধা স্ট্যাম্প নিয়ে অবস্থান।
 ফেসবুকে স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টিরই ছড়ানো ছবি। যেখানে দেখা যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মটির কর্মীরা জাতীয় পতাকা বাঁধা স্ট্যাম্প নিয়ে অবস্থান।

শৈলী আরও জানান, হামলাকারী অনেককে দেখে মনে হলো তাদের ভাড়া করে আনা হয়েছে। অনেককে দেখে শিক্ষার্থী মনে হয়নি। একই কথা জানালেন রফিক আমিনও। তাঁদের বক্তব্যে জানলাম, মেয়েদের ওপর বেশ মারমুখী ছিল হামলাকারীরা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গুরুতর আহত কয়েকজনের মধ্যে একজন রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা, যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য।

আহত এ তরুণীর ছবি দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গীতি আরা নাসরিন এক ফেসবুক পোস্টে জানাচ্ছেন, ‘রুপাইয়ার মাথায় দুই জায়গায় ছয় ইঞ্চি সেলাই। আঙুল ভাঙা হয়েছে। নখ উল্টে গেছে। রক্তাক্ত শরীরে মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর স্ট্যাম্প দিয়ে পায়ে অবিরত বাড়ি দেওয়া হয়েছে, ফলে পা ভেঙে যাওয়ার অধিক যন্ত্রণা।’

ফেসবুকে স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টিরই ছড়ানো ছবি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও তোলা ছবিতে আমরা দেখছি, জাতীয় পতাকা বাঁধা স্টাম্প ও লাঠি নিয়ে তারা অবস্থান নিয়েছিল। সেগুলো দিয়েই চারদিকে ঘিরে পেটানো হয় সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র–জনতার কয়েকজনকে।

অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র–জনতার কারও হাতে লাঠিজাতীয় কিছু ছিল না। তার মানে এটি স্পষ্ট যে স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টের এ হামলা পূর্বপরিকল্পিত ছিল এবং হামলার প্রস্তুতি নিয়েই তারা গিয়েছিল।

নাগরিক সমাজের যেকোনো পক্ষ বা সংগঠন তাদের নীতি-আদর্শ-চিন্তা-চাহিদা অনুযায়ী সরকার বা সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে যেকোনো দাবি জানাতেই পারে। তাদের দাবি কতটা যৌক্তিক বা সে ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বা আদৌ নেওয়া হবে কি না, সেটি বিবেচনা করবে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

সে কর্মসূচিতে যদি এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে বাধা দেওয়ার প্রয়োজন হয়, এর জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে। সেটি তাদের কাজ। এর বাইরে কারও বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সেই কাজটিই করল স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি।

তারা শুধু বাধাই দেয়নি, সন্ত্রাসী আচরণই দেখাল। এটি কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশে থেকে কিংবা তাদের আশকারায় ছাত্রলীগের গুন্ডামি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় না?

অতীতে আমরা এটাও দেখেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের মদদপুষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ এভাবে হামলে পড়ত যে কোনো অধিকার আদায়ের কর্মসূচিতে।

আজকের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নাগরিক সমাজে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্রলীগ ও সেই মুক্তিযোদ্ধার মঞ্চের মতো এই স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টিও ছাড় পেয়ে যাবে কি না? আর কারা এই স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি? পুলিশের সামনে কোন সাহসে বা ক্ষমতাবলে এভাবে একটি পক্ষের কর্মসূচিতে বাধা দেয় ও হামলা চালায়? পুলিশ কেন তাদের বাধা দিল না বা আক্রান্তদের বাঁচানোর চেষ্টা করল না?

আমাদের বন্ধু লেখক ও সাংবাদিক সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ প্রশ্ন রেখেছেন এভাবে—এই ‘সভারেন্টি গুন্ডারা কাদের ‘রেন্ট’ করা? একই প্রশ্ন রেখেই এ লেখা শেষ করতে চাই এ বলে, সরকার হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়, সেটি আমরা দেখতে চাই।

রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.