
সেটি ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড–লিভারপুল ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে। এই প্রতিবাদ কর্মসূচি আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। দল গত মৌসুমেই নেমে গেছে ইউরোপা লিগে, এবার লিগ শুরুর প্রথম দুই ম্যাচেই হার—সব দায় ক্লাবটির মালিকপক্ষ গ্লেজার পরিবারের ঘাড়ে চাপিয়ে তাদের ক্লাব ছাড়ার দাবিতে সরব হয়ে ওঠেন সমর্থকেরা।
খেলোয়াড়েরা জানতেন সমর্থকদের এই প্রতিবাদ কর্মসূচি সমন্ধে। তাই কিছু একটা করার জিদটা সম্ভবত আপনাই তৈরি হয়েছিল মার্কাস রাশফোর্ড–জেডন সানচোদের মধ্যে। জিদ চাপলে কী হতে পারে সেটিও বোঝা গেল ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে শেষ বাঁশি বাজার পর। ম্যাচ শুরুর আগে যে লিভারপুলকে ধরা হয়েছে সম্ভাব্য বিজয়ী, জুয়ার দরেও এগিয়ে ছিল বিস্তর ব্যবধানে, সেই দলটারই জয়ের সম্ভাবনা ম্যাচের ৭০ মিনিটে নেমে আসে মাত্র ২ শতাংশে!
টিভি পর্দায় তখন এই হিসেব দেখে এবং ম্যাচের পর ইউনাইটেডের সমর্থকেরা ভেবে নিতেই পারেন, পৃথিবী থেকে অলৌকিকত্ব বিষয়টি এখনো উঠে যায়নি।
না, ইউনাইটেডকে মোটেও খাটো করে দেখা হচ্ছে না। দলটির পারফরম্যান্সই এভাবে বলার কারণ। কাল রাতের ম্যাচের আগে গত চার বছরে লিগে লিভারপুলের বিপক্ষে জিততে পারেনি ইউনাইটেড। ২০১৮ সালের মার্চে ২–১ গোলের সেই জয়ের পর লিভারপুলের বিপক্ষে টানা ৮ ম্যাচ জয়শূন্য ছিল ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের ক্লাবটি।
ঐতিহ্যবাহী প্রতিদ্বন্দ্বিদের বিপক্ষে কাল রাতের জয়টি তাই ইউনাইটেডের জন্য সত্যিকার অর্থেই বিশেষ কিছু। ক্লাবটির সাবেক জার্মান মিডফিল্ডার বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগার যেমন, ম্যাচ চলাকালীন টিভির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে টুইট করেন, ‘জেগে ওঠো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।’ জয়টা বিশেষ কিছু না হলে সাবেক ক্লাবকে নিয়ে ‘বাস্তি’র হাসিমুখটা অন্তত দেখা যেত না।
আর এই জয়টা যে ইউনাইটেডের সমর্থকদের জন্যও বিশেষ কিছু, তা বুঝিয়ে দেন ক্লাবটির পর্তুগিজ ফুলব্যাক দিওগো দালোত। সমর্থকেরা ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের বাইরে রাস্তায় সমাবেশ করেছে। একটা জয় খুব দরকার ছিল এমন পরিস্থিতিতে। সেটাও লিভারপুলের মতো প্রতিদ্বন্দ্বির বিপক্ষে হওয়ায় সমর্থকেরা অন্তত একটু শান্তি তো পাবেন! দালোত তাই টুইট করেন, ‘এই জয়টা সমর্থকদের জন্য। আজকের সমর্থন বলে বোঝানো যাবে না।’
ইউনাইটেডের একটু বর্ষীয়ান সমর্থকেরা সম্ভবত ম্যাচে বিরতির পরই জয়োল্লাস শুরু করেন। ১৯৮৪ সাল থেকে ঘরের মাঠে ম্যাচের প্রথমার্ধে এগিয়ে যাওয়ার পর কখনো হারেনি ইউনাইটেড। কিন্তু রিও ফার্দিনান্দ ভীত ছিলেন। এক সময়ের সবচেয়ে দামি এই ডিফেন্ডার নিজের সাবেক দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু দারুণ জয়ের পর তাঁর ভাবনাটা পাল্টে যায়।
নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ফার্দিনান্দ বলেছেন, ‘ম্যাচের আগে একটু ভীত ছিলাম। কী ঘটবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড মাঠে নেমে বুঝিয়ে দিয়েছে, এখন থেকে এটাই তাদের বেঞ্চমার্ক। জয়ের ইচ্ছা, আক্রমণাত্বক মানসিকতা এবং পরিশ্রম দিয়ে ফলটা পেয়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, যা গত সপ্তাহে দেখা যায়নি, অতীতে অনেক ম্যাচেই এসব অনুপস্থিত ছিল।’
লিভারপুলের বিপক্ষে কাল রাতে ইউনাইটেডের ২–১ গোলের দুর্দান্ত জয়টা দেখেছেন রয় কিন। ইউনাইটেডের সাবেক এই অধিনায়কও তাঁর সাবেক দলের আক্রমণাত্বক মানসিকতায় মুগ্ধ, ‘(কাল) আজ রাতে যে বিষয়টি ভালো লেগেছে, খেলোয়াড়েরা দল হিসেবে খেলেছে। রক্ষণ, মাঝমাঠ এবং আক্রমণে বিপজ্জনক ছিল দল। তারা আরও গোল করতে পারত এবং জয়টা প্রাপ্যই ছিল।’
ইউনাইটেডের লেফটব্যাক টাইরেল ম্যালাসিয়া ম্যাচে দুর্দান্ত খেলেছেন। মোহাম্মদ সালাহ জটলা থেকে একটি গোল করলেও মিসরীয় ফরোয়ার্ডকে বাঁ প্রান্তে ভালোভাবেই আটকে রাখেন এই ডাচ ডিফেন্ডার। ইউনাইটেডের হয়ে জেডন সানচোর প্রথম গোলের পর ম্যালাসিয়ার উদ্যাপন ছিল ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো। ছবিটি মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কিছু সমর্থক তাঁকে ‘নতুন এভরা’ তকমাও দিয়েছেন।
এ ম্যাচে সবচেয়ে বেশি সফল ট্যাকল (৫টি) এবং চারবার প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়েছেন ম্যালাসিয়া। ইউনাইটেডের হয়ে বলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চসংখ্যক ‘টাচ’ও তাঁর, সেটাও ডিফেন্ডার হিসেবে! ৯০ শতাংশের বেশি সফল পাস দিয়েছেন ম্যালাসিয়া, যা দুই দলের একাদশের হয়ে মাঠে নামা খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ। স্কাই স্পোর্টসে কথা বলার সময় ম্যালাসিয়ার প্রশংসাই করলেন ইউনাইটেড সাবেক ডিফেন্ডার গ্যারি নেভিল, ‘এই ছেলেটার মধ্যে কিছু একটা আছে। সাহস আছে, তেজ আছে!’

ম্যালাসিয়ার মধ্যে নেভিল যা দেখেছেন, সেসব আসলে ইউনাইটেডের খেলাতেই ফুটে উঠেছে। সাহসের সঙ্গে খেলে জিতেছে ইউনাইটেড, এমনটাই মনে করেন দলটির কোচ এরিক টেন হাগ, ‘সবাই কৌশলগত বিষয় সামনে টেনে আনতে চাচ্ছে, কিন্তু আমার মনে হয় মানসিকতা বড় ভূমিকা রেখেছে। বোঝাপড়া ভালো ছিল, সবাই লড়াই করতে চেয়েছে এবং দল হিসেবে খেলেছে। এভাবে খেললে কী অর্জন করা যায় সেটা তো দেখাই গেল। ছেলেরা দুর্দান্ত ফুটবল খেলতে পারে।’