এমনিতে লাজুক স্বভাবের ঋতুপর্ণা চাকমা। কিন্তু সেই লাজুক মেয়েটিই মাঠে একেবারে অন্য রকম। পায়ের কাজ, গতি, স্ট্যামিনা—মনেই হয় না এই ঋতুই মাঠের বাইরে একেবারে চুপচাপ, সব সময় লেগে আছে লাজুক হাসি। আজ কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে ঋতুপর্ণা কী অসাধারণ খেলাটাই না খেললেন। তাঁরই দুর্দান্ত এক গোলে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাফের শ্রেষ্ঠত্ব বাংলাদেশের।
দারুণ খেললেও নিজে কেন গোল পান না, তা নিয়ে একটা আক্ষেপ ছিল বাংলাদেশ নারী দলের এই ফরোয়ার্ডের, ‘চেষ্টা তো করছি। কেউ গোল করতে না পারলে কী করার আছে।’ বাংলাদেশ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনাল নিশ্চিত করার পর নিজের গোলখরা নিয়ে আক্ষেপ করে এই কথাগুলো বলেছিলেন ঋতুপর্ণা চাকমা।
কিন্তু কে জানত, টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোলটাই আসবে তাঁর পা থেকে; বাংলাদেশের শিরোপাজয়ী গোলটিই অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য।
সেমিফাইনালে ভুটানকে ৭-১ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার পথে বাংলাদেশের হয়ে গোলের খাতা খুলেছিলেন ঋতুপর্ণাই। এরপর আজ ফাইনালে নেপালের বিপক্ষে ম্যাচ যখন ১-১ গোলে সমতায়, তখন ৮১ মিনিটে তাঁর করা দুর্দান্ত এক গোলই ট্রফিতে খোদাই করে দিয়েছে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশকে টানা দ্বিতীয়বার শিরোপা জিতিয়ে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ও হয়েছেন ঋতুপর্ণা। অন্য দিকে গতবারের মতো এবারও সাফের সেরা গোলকিপার রুপনা চাকমা। টুর্নামেন্টেরজুড়ে ধারাবাহিকতার ফল পেয়েছেন এই গোলকিপার।
রুপনা টুর্নামেন্টে হজম করেছেন মাত্র ৪ গোল। ফাইনালে বল কয়েকবার তাঁর হাত ফসকালেও তা দলের জন্য বিপদ হয়ে আসেনি। আবার দারুণ কিছু গোলও বাঁচিয়েছেন রুপনা। গতবারও প্রতিযোগিতার সেরা গোলকিপার হয়েছিলেন। এবারও সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন তিনি। প্রতিপক্ষের আক্রমণগুলো পড়তে পেরেছেন দারুণভাবে। নিজের বুদ্ধিমত্তার কারণে শট নেওয়ার জন্য প্রতিপক্ষকে জায়গাও দিয়েছেন অনেক কম।
ঋতুর কথায় ফেরা যাক। সাফে মাত্র ২ গোল করলেও খেলেছেন দুর্দান্ত। প্রতিটি ম্যাচেই তাঁর প্রভাব ছিল অসামান্য। ফাইনালে তো খেলেছেন অসাধারণ। ঋতু তাঁর গতি দিয়ে লেফট উইং দিয়ে বারবারই ঢুকে পড়েন। ফাইনালে প্রথমার্ধের শুরু থেকেই বাংলাদেশের আক্রমণগুলো গড়ে উঠছিল তাঁর প্রান্ত দিয়ে।
বাঁ প্রান্ত দিয়ে গড়া এই আক্রমণগুলোর রূপকারও ছিলেন ঋতুপর্ণাই। নেপালের আঁটসাঁট রক্ষণকে বারবার হুমকিতে ফেলেছেন এই ফরোয়ার্ড। এমনকি দলের প্রয়োজনে নিচে নেমেও দলকে সাহায্য করেছেন ঋতুপর্ণা। আর ম্যাচজুড়ে পরিশ্রমের ফল ঋতুপর্ণা পান ম্যাচের শেষ দিকে।
ম্যাচ যখন ১-১ সমতায়, তখন বাঁ প্রান্ত দিয়ে লেগে থাকা মার্কারকে গতিতে পেছনে ফেলে বক্সের বেশ বাইরে থেকে শট নেন ঋতুপর্ণা। এ সময় নেপালি কিপারের কাছের পোস্টে এগিয়ে আসার বিষয়টিও বেশ ভালোভাবে লক্ষ করেছিলেন। তাই শটটা নেন দূরের পোস্ট লক্ষ্য করে, যা শেষ পর্যন্ত হাত লাগিয়েও বিপদমুক্ত করতে পারেননি নেপালের গোলকিপার আনজিলা সুব্বা। আর বাংলাদেশ পেয়ে যায় জয়সূচক গোল। শিরোপা জয়ের পর তাঁর উদ্যাপনও ছিল দেখার মতো।
টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে পেয়েছেন অর্থ পুরস্কার। ম্যাচের শেষে তাঁর হাতে যখন সেই অর্থের চেক তুলে দেওয়া হলো, তখন জানালেন, পুরস্কারের টাকা দিয়ে মায়ের জন্য কিছু জিনিস নিয়ে যাবেন দেশে। নিজের অভিব্যক্তিতে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন দেশের মানুষের প্রতি, ‘দেশের মানুষের দোয়া আর ভালোবাসায় আমরা সফল হয়েছি।’
মায়ের জন্য ঋতু হয়তো অনেক কিছু কিনে ফিরবেন নেপাল থেকে। কিন্তু দেশের মানুষকে আনন্দের উপলক্ষ এনে দিলেন, সেটি অমূল্য। ঋতু, রুপনা, মনিকা, সাবিনা, মাসুরা, দুই শামসুন্নাহারসহ পুরো নারী দলই যে নিজেদের নাম খোদাই করে ফেললেন বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে।