বিশ্বের অন্যতম সুপেয় পানির আধার বাংলাদেশে এখন পানিই বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের উপকূলীয় এলাকার ২০ শতাংশ নারী লবণাক্ততার কারণে অকালগর্ভপাতের শিকার হন। গর্ভাবস্থায় এসব নারী লবণাক্ত পানি পান করেন। এতে তাঁদের খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপ হয়। দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় এখানকার নারীদের গর্ভাবস্থায় সন্তান বেশি মারা যায়।
শুধু তা–ই নয়, লবণাক্ততার কারণে দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় উপকূলের মানুষের মৃত্যুহারও বেশি; বিশেষ করে শিশুদের মৃত্যু এখানে বেশি হয়। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকাশিত ‘মান অজানা: পানির অদৃশ্য সংকট’ শীর্ষক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্বের পানির দূষণ ও সংকট নিয়ে করা ওই প্রতিবেদনে ঘুরেফিরে বাংলাদেশের পানির সমস্যার বিষয়টি উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়েছে, লবণাক্ততার কারণে প্রতিবছর বিশ্বের ১৭ কোটি মানুষের প্রয়োজনের সমপরিমাণ খাদ্য উৎপাদন কম হয়। শুধু লবণাক্ততাই নয়, বিশ্বজুড়ে পানির নতুন বিপদ হিসেবে অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার সমস্যাকে সামনে আনা হয়েছে। একই সঙ্গে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আর্সেনিকের কারণে পানিদূষণের বিষয়টি উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, এসব সমস্যা বিশ্বের সুপেয় পানির উৎসগুলোকে বিষিয়ে তুলছে।
বিশ্বের অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার বিপদের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মোড়ক ও পানিয়র পাত্র হিসেবে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। এসব প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। প্লাস্টিকের অতি ক্ষুদ্র কণা পানির সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করে ক্যানসার থেকে শুরু করে নানা রোগব্যাধি তৈরি করছে।
বিশ্বব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের ৮০ শতাংশ সুপেয় পানি, ট্যাপের পানির ৮১ শতাংশ ও বোতলজাত পানির ৯৩ শতাংশ ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার দূষণের শিকার। বাংলাদেশেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনটির ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে পানিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইড বাংলাদেশ’র কান্ট্রি ডিরেক্টর খায়রুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে লবণাক্ততা একটি বড় সমস্যা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। এ সমস্যা যে হারে বাড়ছে, তার সমাধানের উদ্যোগ সেই হারে এগোচ্ছে না। উপকূলীয় এলাকায় বেশি করে মিষ্টিপানির পুকুর খনন থেকে শুরু করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার উদ্যোগের ওপর গুরুত্ব দেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ১২ শতাংশ মানুষ এখনো আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে। আর গড়ে উপকূলের ৩ শতাংশ শিশু লবণাক্ততার কারণে মারা যায়। এই হার বরিশাল বিভাগে প্রায় ২০ শতাংশ। এসব এলাকার নারীরা প্রতিদিন গড়ে ২০ কিলোমিটার দূর থেকে মিষ্টিপানি সংগ্রহ করে। এতে তাঁদের নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হয়।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পানিদূষণের আরেকটি কারণ হিসেবে কৃষিকাজে মাটিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারকে দায়ী করা হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, বিশ্বে গড়ে প্রতি হেক্টর জমিতে ৬৮ দশমিক ৭৫ কেজি ইউরিয়া, ২৯ দশমিক ৪৮ কেজি ফসফেট ও ২৩ দশমিক ৭৬ কেজি পটাশিয়াম সার ব্যবহার করা হয়। আর বাংলাদেশে তা যথাক্রমে ১৪৫ কেজি, ৬৫ কেজি ও ৪১ কেজি ব্যবহৃত হয়। ইউরিয়া ও ফসফেট ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান চীনের পরেই, আর পটাশিয়ামে তৃতীয়। এসব সার ব্যবহারে শীর্ষ রয়েছে চীন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ‘বাংলাদেশে ইউরিয়ার ব্যবহার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি হয় এটা ঠিক। কারণ, আমাদের কৃষকদের মধ্যে একটি ধারণা আছে, ইউরিয়া বেশি দিলে ফসল দেখতে সবুজ হয়। এতে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হয়। ফলে অন্যান্য সার ও কীটনাশকের পরিমাণ বেশি দিতে হয়। ফলে সামগ্রিকভাবে ইউরিয়ার ব্যবহার শুধু পানিদূষণ করছে না, মাটি ও ফসলেরও ক্ষতি করছে। তাই ইউরিয়ার ব্যবহার কমাতে আরও বেশি উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কৃষকদেরও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।