ইরানের ফরদো পারমাণবিক স্থাপনা কি ধ্বংস করা সত্যিই অসম্ভব, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

0
17
ইরানের পারমাণবিক শিল্পবিষয়ক একটি প্রদর্শনী ঘুরে দেখছেন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি, তেহরান, ১১ জুন ২০২৩ উৎস: এক্স থেকে

পাহাড় কেটে ঢুকে পড়েছে পাঁচটি সুড়ঙ্গ, পাশে দাঁড়িয়ে বিশাল এক কাঠামো, আর চারপাশে সুপ্রসারিত নিরাপত্তাপ্রাচীর—ইরানের ফরদো জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রের সাম্প্রতিক একটি স্যাটেলাইট ছবিতে এমনই দেখা গেছে।

ইরানের পবিত্র শহর কোমের কাছাকাছি স্থানে এ গোপন ও কড়া নিরাপত্তাবেষ্টিত পারমাণবিক স্থাপনাটি অবস্থিত। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে আসার পর থেকে এর আসল প্রকৃতি ও পরিসর নিয়ে ব্যাপক জল্পনাকল্পনার শুরু হয়।

স্থাপনাটি সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যত তথ্য পাওয়া গেছে, তার বেশির ভাগই মিলেছে কয়েক বছর আগে ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের চুরি করে আনা ইরানের গোপন নথি থেকে।

এর মূল কক্ষগুলো মাটির নিচে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ মিটার (প্রায় ২৬০ থেকে ৩০০ ফুট) গভীরে। এত গভীরে এর অবস্থান হওয়ায় ইসরায়েলের যেকোনো বিমান থেকে সেখানে বোমা দিয়ে ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব।

ইসরায়েলের হামলায় ইরানের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কমান্ডার নিহত হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, ফরদোতে ইরান তাড়াহুড়া করে মজুদকৃত ইউরেনিয়াম থেকে পারমাণবিক বোমা বানানোর চেষ্টা করতে পারে।

ইসরায়েল এ কেন্দ্র লক্ষ্য করে সম্প্রতি হামলা চালালেও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার মতে, তারা এখন পর্যন্ত এ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি, নয়তো এমন ইচ্ছা প্রকাশ করেনি।

তেহরান বহুদিন ধরে দাবি করে আসছে, শুধু শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে তারা পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। কিন্তু তারপরও ফরদো নিয়ে ইরানের প্রকৃত অভিপ্রায় সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন রয়েছে।

২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন এক যৌথ ঘোষণায় প্রথমবারের মতো ফরদোর অস্তিত্বের কথা প্রকাশ করেন। তখন ওবামা বলেছিলেন, ‘এই কেন্দ্রের আকার ও গঠন এটির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির সঙ্গে মেলে না।’

ফরদো পারমাণবিক সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্রের সামনে ইরানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী কাজেম ঘারিব আবাদি (ডানে) এবং আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি (বাঁ থেকে দ্বিতীয়), ১৫ নভেম্বর ২০২৪
ফরদো পারমাণবিক সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্রের সামনে ইরানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী কাজেম ঘারিব আবাদি (ডানে) এবং আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি (বাঁ থেকে দ্বিতীয়), ১৫ নভেম্বর ২০২৪ছবি: রয়টার্স

পারমাণবিক চুক্তি ও ইসরায়েলি অভিযোগ

২০১৫ সালে ‘ইরান পারমাণবিক চুক্তি’ নামে পরিচিত জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) করা হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী ইরানকে ফরদোর ভেতর থেকে দুই-তৃতীয়াংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের যন্ত্র বা সেন্ট্রিফিউজ সরাতে হয় এবং সব ধরনের পারমাণবিক উপাদান সরিয়ে নিতে হয়। ফলে ফরদো থেকে বিপদের আশঙ্কা অনেকটা প্রশমিত হয়। এরপর এ স্থাপনায় এমন কর্মকাণ্ড পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়। তবে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসার পর পরিস্থিতি আবার পাল্টে যেতে শুরু করে।

২০১৮ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেন, ইসরায়েলি গোয়েন্দারা ইরানের কথিত ‘পারমাণবিক আর্কাইভ’ থেকে ৫৫ হাজারের বেশি গোপন নথি উদ্ধার করেছে। এতে ফরদো পারমাণবিক স্থাপনার বিস্তারিত নকশা ছিল। এ ছাড়া ফরদোর লক্ষ্য সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া গেছে এসব নথিতে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ফরদোর লক্ষ্য ছিল প্রতিবছর এক বা দুটি পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব হয়, এমন মাত্রায় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা।

নথিপত্র বিশ্লেষণকারী বিশেষজ্ঞ আলব্রাইট বলেন, ‘আমরা এর মধ্যে কোনো অসামঞ্জস্যতা দেখিনি। এটা কয়েক লাখ পৃষ্ঠার দলিল। এসব বানিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। কেউ এগুলোর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না বলে সম্ভবত আইএইএ বোর্ড ইরানের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস করেছে।’

তবে সে সময় ইরানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি এই অভিযোগগুলোকে ‘শিশুসুলভ’ ও ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দেন।

সবচেয়ে শক্তিশালী বোমার আঘাত থেকেও সুরক্ষিত

সম্প্রতি প্রকাশিত আইএইএর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ইরান ফরদো স্থাপনায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের উৎপাদন ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। সেখানে বর্তমানে ২ হাজার ৭০০টি সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে বলে আইএইএ ও বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন।

আইএইএ গত ৩১ মে দাবি করেছে, ‘ইরান একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন দেশ, যারা এত বেশি পরিমাণে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে খুব বড় উদ্বেগ তৈরি করেছে।’

আলব্রাইট বলছেন, এটা দেখে মনে হচ্ছে, ইরান এমনভাবে কাজ করছে, যেন ভবিষ্যতে যদি পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে চায়, তাহলে যেন তারা তৈরি থাকে। আর যদি কেউ ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরি করতে পারে, তাহলে সেটা খুব সহজেই অস্ত্র তৈরির উপযোগী ইউরেনিয়ামে রূপান্তর করা যায়।

আইএসআইএস নামের একটি চিন্তক প্রতিষ্ঠান বলছে, ইরান ফরদো পারমাণবিক স্থাপনায় মাত্র তিন সপ্তাহে ২৩৩ কেজি অস্ত্রমান ইউরেনিয়াম তৈরি করতে পারে, যা ৯টি পারমাণবিক বোমার জন্য যথেষ্ট।

ইসরায়েলের মার্কিন দূত ইয়েচিয়েল লেইটার যুক্তরাষ্ট্রকে কিছুটা উসকে দিয়েছেন। তাঁর ভাষ্য হচ্ছে, ফরদোতে আকাশ থেকে বোমা মারার মতো শক্তিশালী বোমা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আছে। এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকেই, তারা এ কাজ করবে কি না।’

যুক্তরাজ্যের একটি প্রখ্যাত প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রুসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিবিইউ ৫৭/বি বোমা দিয়েও ফরদোর মতো স্থাপনায় প্রবেশ করতে হলে সম্ভবত একাধিকবার ঠিক একই জায়গায় আঘাত হানতে হবে। তবেই ভেতরে ঢোকার মতো কোনো বাস্তব সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.