ইমরানের দুর্নীতিবিরোধী জিহাদ নিয়ে প্রশ্ন, কারাগারে সাবেক প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীরা

0
385
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ছবি: রয়টার্স

এই মুহূর্তে পাকিস্তানের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও দুজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাগারে আছেন। দুর্নীতির অভিযোগে তাঁদের কারাগারে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারবিরোধীদের অভিযোগ, ইমরান খানের সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দুর্নীতি দমনের কথা বলে তাঁদের কারাগারে পাঠিয়েছে।

‘নয়া পাকিস্তান’ গড়ার স্লোগান তুলে দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ইমরান খান। নয়া পাকিস্তান গড়তে নানা পদক্ষেপের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদের কথা বলেছিলেন তিনি। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর দুর্নীতিবিরোধী অভিযান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষবিরোধী অভিযানে রূপ নিয়েছে। অন্তত দেশটির বিরোধী দলগুলোর এমনটাই বলছে।

এই মুহূর্তে পাকিস্তানের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও দুজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাগারে আছেন। এর মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি পার্লামেন্টের তৃতীয় বৃহত্তম দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) কো-চেয়ারম্যান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী দুজন হলেন নওয়াজ শরিফ ও শহীদ খাকান আব্বাসি। নওয়াজ শরিফ তিনবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। যদিও তিনবারই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বিদায় নিতে হয়েছে প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লিগের (এন) এই নেতাকে। আর শহীদ খাকান আব্বাসি হলেন নওয়াজের দলের নেতা। নওয়াজ সর্বশেষ মেয়াদে (২০১৩-১৭) প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় আদালতের আদেশে অযোগ্য ঘোষিত হলেন তাঁর দল প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে শহীদ খাকান আব্বাসিকে। তাঁকে ১৮ জুলাই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।

আসিফ আলি জারদারি। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। ছবি: এএফপি।

দেশটির প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর স্বামী আসিফ আলী জারদারিকে গত ১০ জুন ইসলামাবাদের নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাকিস্তানের ডন পত্রিকার খবর অনুযায়ী, আসিফ জারদারিকে ভুয়া ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে অর্থ পাচারের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিবিসি বলেছে, ভুয়া বেশ কয়েকটি ব্যাংক হিসাব থেকে শত শত কোটি রুপি বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। শুধু আসিফ জারদারি নন, তাঁর ছেলে ও পিপিপির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টোর বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। যদিও জারদারির গ্রেপ্তারের পর বিলাওয়াল বলেন, মিথ্যা অভিযোগে তাঁর বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এমন মামলা দেওয়া হয়েছে।

জারদারি ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্ত্রী বেনজির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময় অনিয়ম, দুর্নীতি ও কমিশন নেওয়ার অভিযোগে ‘মি. টেন পার্সেন্ট’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন জারদারি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মাধ্যমে বিদেশে সম্পত্তি কেনায় সাত বছর দণ্ডিত হন। সেই দণ্ডভোগ করছেন তিনি। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আরও বেশ কয়েকটি মামলা বিচারাধীন। নওয়াজের মেয়ে মরিয়মও অভিযোগ করেছেন, তাঁর বাবাকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় দণ্ড দেওয়া হয়েছে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থ দিয়ে বিদেশে সম্পত্তি করাসংক্রান্ত দুর্নীতির মামলায় নওয়াজের মেয়ে মরিয়ম ও তাঁর স্বামী অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ সফদারকেও কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁরা জামিনে রয়েছেন। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় নওয়াজের ভাতিজা হামজা শরিফকেও। হামজা পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা। আর তাঁর বাবা শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলের নেতা। দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের খবর বলা হয়, ১৭ জুলাই অ্যাকাউন্টিবিলিটি আদালত শাহবাজ, তাঁর স্ত্রী, এক মেয়ে ও হামজাসহ দুই ছেলের সম্পত্তি ফ্রিজ (লেনদেন নিষিদ্ধ) করেছেন।

নওয়াজ শরিফ। তিনবারের নির্বাচিত এই প্রধানমন্ত্রী একবারও মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। ছবি: রয়টার্স।

পাকিস্তানের বর্তমান পার্লামেন্টের প্রধান দুই দল হলো পিএমএল-এন ও পিপিপি। এই দুই দলে শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা ছাড়াও প্রথম সারির অনেক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা রয়েছে। তাঁদের ধরতে গ্রেপ্তার অভিযানও চলছে।

জারদারি গ্রেপ্তার হওয়ার পরদিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান। তিনি বলেন, দেশের বর্তমান ভঙ্গুর অর্থনীতির জন্য দায়ী দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের তিনি শাস্তির আওতায় আনবেন। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করছেন—এমন অভিযোগ উড়িয়ে দেন তিনি। ইমরান বলেন, ‘বর্তমান বিচার বিভাগ স্বাধীন। যে অ্যাকাউন্টিবিলিটি আদালত নওয়াজকে দণ্ড দিয়েছেন ও জারদারিকে গ্রেপ্তার করিয়েছেন, তার চেয়ারম্যানকে আমরা নিয়োগ দিইনি। যে মামলাগুলো তাঁদের বিরুদ্ধে রয়েছে, সেগুলোও আমরা ক্ষমতা গ্রহণের আগে দায়ের করা। নওয়াজ ও জারদারি নিজেরাই পরস্পরকে দুর্নীতিবাজ বলেছেন। নওয়াজ ক্ষমতায় থাকতে দুবার জারদারিকে জেলেও পাঠিয়েছিলেন।’

ইমরানের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তোলার পক্ষে যুক্তি আছে। কারণ, দেশটিতে যে শুধু রাজনীতিকেরাই দুর্নীতি করেছেন তা তো নয়। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগসহ আরও যে রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো রয়েছে, তার ছোট-বড় কর্তাব্যক্তিরাও তো কমবেশি জড়িত ওই দুর্নীতিতে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো আমলা বা শীর্ষ পর্যায়ের কোনো কর্তাকে দুর্নীতির দায়ে অপসারণ কিংবা গ্রেপ্তারের কথা শোনা যায়নি। ইমরান খান তাঁর বক্তৃতায় দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের কথা বারবার বলেছেন, কিন্তু এড়িয়ে গেছেন সরকারি-বেসরকারি খাতের দুর্নীতির কথা।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শহিদ খাকান আব্বাসি। ছবি: এএফপি।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালানোর ইতিহাস পাকিস্তানে রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটা করেছে দেশটির শক্তিশালী সেনাবাহিনী। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতে বিভিন্ন সময় দুর্নীতিকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে তারা। আর ইমরানও যেন তেমনটাই করছেন। বিরোধী দলগুলো ইমরানকে সেনাবাহিনীর ‘হাতের পুতুল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ পেয়েই ইমরান যে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তাও কমবেশি সবার জানা।

লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চাথাম হাউসের বিশ্লেষক ফারজানা শেখ ব্রিটিশ দৈনিক টেলিগ্রাফকে বলেন, পাকিস্তানের বিগত নির্বাচিত সরকারগুলো ক্ষমতা হারানোর পর অভিযোগ তুলেছিল, সামরিক বাহিনীর চাপের কারণে তারা ভালোভাবে কাজ করতে পারেননি। জনগণের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু ইমরান খান এমন অজুহাত তুলতে পারবেন না। কারণ, ইমরান সেনাবাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, এটা ‘ওপেন সিক্রেট’ বিষয়।

ইমরানকে আসলে প্রমাণ করতে হবে, সামরিক বাহিনীর মতো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে নয়, সত্যিকার অর্থেই দুর্নীতির মূলোৎপাটনের জন্যই অভিযান চালাচ্ছেন তিনি। আর এই অভিযান শুধু দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে নয়, সরকারি-বেসরকারি খাতসহ সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধেই। সেটা করতে না পারলে নওয়াজ-জারদারির অভিযোগ খণ্ডাতে পারবেন না ইমরান। আরেকটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান যুক্ত হবে পাকিস্তানের ইতিহাসে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.