সিলেটের বিএনপিদলীয় বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী দলের সিদ্ধান্ত মেনে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেননি। তবে কাউন্সিলর পদে বিএনপিপন্থী ৪১ জন এবং জামায়াতপন্থী ২০ জন নেতা-কর্মী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ফলে তাঁদের অনুসারীদের অনেকে ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন। তাই আওয়ামী লীগের বিরোধী বলয়ের এসব ভোট কার বাক্সে পড়বে, এ সমীকরণ নিয়েই এখন চলছে জোর আলোচনা।
২১ জুন এ সিটিতে ভোট হবে। মেয়র পদে সাতজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও আলোচনায় আছেন তিনজন। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, জাতীয় পার্টির মো. নজরুল ইসলাম (বাবুল) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাহমুদুল হাসান। বিএনপি-জামায়াত ভোট বর্জন করায় দল দুটির ভোটব্যাংকে ভাগ বসাতে নজর দিয়েছেন জাপা ও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী।
মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী অপর চার প্রার্থী হচ্ছেন জাকের পার্টির মো. জহিরুল আলম এবং স্বতন্ত্র মো. আবদুল হানিফ (কুটু), মো. শাহ জামান মিয়া ও মো. ছালাহ উদ্দিন (রিমন)। এ সিটিতে মোট ভোটার ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৬০৫ জন। মোট কেন্দ্র ১৯০টি এবং ভোটকক্ষ ১ হাজার ৩৬৪টি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীরা এরই মধ্যে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। জামায়াত তাদের নেতা-কর্মীদের প্রার্থিতার বিষয়ে ‘চুপচাপ নীতি’ অবলম্বন করছে। তবে স্থানীয়ভাবে সুপরিচিত বিএনপি-জামায়াতপন্থী নেতারা প্রার্থী থাকায় দল দুটির অনেক ভোটার কেন্দ্রে যাবেন। ফলে এ ভোটব্যাংক যে প্রার্থীর পক্ষে ঝুঁকবে, তিনিই হবেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী।
স্থানীয় একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে, জাতীয় পার্টির প্রার্থীর দিকেই বিএনপি-জামায়াত অনুসারী ভোটাররা বেশি ঝুঁকবেন। আবার একটা অংশ ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর পক্ষেও ঝুঁকতে পারে। এ ছাড়া সিলেটে অন্য ইসলামী দলগুলোরও ভালো একটা ভোটব্যাংক আছে। এসব ভোট আবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরই বেশি পাওয়ার কথা। সেসব হিসাব-নিকাশই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।
সিলেট সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ লোকদেখানো কাজ নিয়ে ব্যস্ত, দাবি আ.লীগ নেতার
সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘যেহেতু বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে সব ধরনের নির্বাচন বর্জন করেছে, তাই কোন ভোটার কাকে ভোট দিলেন, কে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন, এ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। অধিকাংশ ভোটার কেন্দ্রে যাবেন না, এটাই আমরা ধারণা করছি।’
সিলেট মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি মোহাম্মদ শাহজাহান আলী বলেন, ‘বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলীয়ভাবে তাঁরা বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। তাই সিটি নির্বাচনেও নেই। জামায়াতের যেসব কাউন্সিলর প্রার্থী আছেন বলে বলা হচ্ছে, আসলে তাঁরা দলের পদধারী কেউ নন। তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থী হয়েছেন। তাই ভোট দিতে জামায়াতের অনুসারীদের কারা কেন্দ্রে যাবেন কিংবা মেয়র হিসেবে কাকে ভোট দেবেন, এ নিয়ে আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই।’
সর্বশেষ সিটি নির্বাচনের ফল অনুসারে বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ৯২ হাজার ৫৮৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের বদরউদ্দিন আহমদ কামরান পান ৮৬ হাজার ৩৯২ ভোট। জামায়াত সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী এহসানুল মাহবুব পান ১০ হাজার ৯৫৪ ভোট। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মোয়াজ্জেম হোসেন পান ২ হাজার ১৯৫ ভোট। গত নির্বাচন ২৭টি ওয়ার্ডে হলেও এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২টিতে।
সিলেট সিটি নির্বাচন ঘিরে হঠাৎ আলোচনায় আনোয়ারুজ্জামান, আ.লীগে ‘চাপা ক্ষোভ’
বিএনপি ও জামায়াতের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের অনুসারী ভোটাররা যদি কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোট দিতে কেন্দ্রে যান, তাহলে নৌকা প্রতীকে তাঁরা কোনোভাবেই ভোট দেবেন না। সে ক্ষেত্রে যাঁকে ভোট দিলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলা সম্ভব হবে, তাঁর দিকেই তাঁরা ঝুঁকবেন। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সুবিধা পেতে পারেন। কারণ, বিএনপি-জামায়াতের ভোট দেওয়ার মতো এখানে সমমনা বিকল্প কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী কিংবা স্বতন্ত্র কোনো প্রার্থী নেই।
যদিও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী মাহমুদুল হাসান সরকারবিরোধী বলয়ের ভোট তাঁর পক্ষেই আসবে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি আর আওয়ামী লীগ তো একই ঘরানার। জাতীয় পার্টিকে ভোট দেওয়া মানে আওয়ামী লীগকেই ভোট দেওয়া। প্রার্থীর কিছু জনভিত্তি থাকা দরকার, রাজনৈতিক ভিত্তি থাকা দরকার, সবকিছু মিলিয়েই ভোটাররা ভোট দেবেন। মেয়র আরিফুল সাহেব নির্বাচনে থাকলে ভিন্ন কথা ছিল। যেহেতু তিনি নেই, তাই তাঁর ভোট আমার দিকেই ফোকাস হবে বলে মনে করছি।’
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যদি বিএনপি-জামায়াতের ভোটাররা আমাকে যোগ্য মনে করেন এবং ভালোবাসেন, তাহলে নিশ্চয়ই তাঁরা আমাকে ভোট দেবেন। আমি মনে করি, এ নগরের সঠিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে দলমত-নির্বিশেষে ভোটাররা লাঙ্গল প্রতীকে ভোট দেবেন।’
সিলেট মেয়র পদে নির্বাচন করতে চান আ.লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর আজাদুর
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি ও জামায়াতের দুজন নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ব্যাপারে অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যে নেতিবাচক ধারণা অনেকটা কম। তাঁদের দৃষ্টিতে, আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সিলেটের দীর্ঘকালের রাজনৈতিক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। সরকারি দলের প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত তাঁর আচার-আচরণ বিরোধী পক্ষের জন্য আশঙ্কার কিছু নেই। ফলে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী ভোটারদের একটা অংশের ভোট নৌকার বাক্সে যাওয়ারও সম্ভাবনা আছে।
নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কাকে মনে করেন জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আমার কাছে সব প্রার্থীই সমান ও গুরুত্বপূর্ণ। কাউকেই অবহেলা করার সুযোগ নেই। আর সব ভোটারই আমার কাছে সমান। সিলেটের মানুষ সুপরিকল্পিত উন্নয়ন চান। তাই নগরের বৃহত্তর উন্নয়নের স্বার্থে দলমত-নির্বিশেষে সবাই আমাকে ভোট দেবেন, এমনটাই আমি চাই।’
আওয়ামী লীগের বিরোধী বলয়ের ভোট কার পক্ষে যেতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘যেহেতু আমার দল নির্বাচনে নেই এবং আমি দলের সিদ্ধান্ত মেনে নির্বাচনে অংশ নিইনি, তাই এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তবে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় ভোটাররা এখন ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন কি না, এ নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।’