নাম তার ‘বাটাগুর বাসকা’। গোটা দুনিয়ার বুনো পরিবেশ থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া কাছিমটি বাঁচাতে বড় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশে।
সাল ২০১০। গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে গড়ে তোলা হলো একটি কৃত্রিম প্রজননকেন্দ্র। ২০১৩ সাল থেকে এই কেন্দ্রের তকারকির দায়িত্ব এল আমার কাঁধে। সে সময় প্রায় প্রতি সপ্তাহেই যেতাম ওই প্রজননকেন্দ্রে। নুরু নামের একটি ছেলে সর্বক্ষণ আমাদের কচ্ছপগুলোর দেখাশোনা করত। আর এ জি জে মোরদেশ ও ভারতীয় গবেষক রুপালি ঘোষ ছিলেন তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায়। এক যুগ ধরে সবার কঠোর পরিশ্রমের ফলে এই বাটাগুরের বাচ্চা এখন পাঁচ শতাধিক। চলছে বুনো পরিবেশে ওদের ফিরিয়ে দেওয়ার সব চেষ্টা।
বাটাগুর প্রজননকেন্দ্রের এক কোনায় আরও এক জাতের কচ্ছপ ছিল। নাম পাহাড়ি শিলা কচ্ছপ। ইংরেজি নাম এশিয়ান জায়ান্ট টরটয়েস। সংখ্যায় ছিল তিনটি। সবই নারী। পুরুষ কচ্ছপ না থাকায় এদের প্রজনন করানো যাচ্ছিল না।
বিশ্বব্যাপী মহাবিপন্ন এই কচ্ছপ বুনো পরিবেশ থেকে হারিয়ে গেছে বললেই চলে। টিকে আছে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায়। এই কচ্ছপগুলোর একেকটির ওজন প্রায় ২৫ কেজি। বড় ও ওজনদার হওয়ায় পাহাড়ি শিকারিদের প্রিয় কচ্ছপ ছিল এই শিলা কচ্ছপ।
এমন একটি বিরল কচ্ছপ রক্ষায় সত্যিই উদ্যোগ দরকার। এগিয়ে এলেন তরুণ কচ্ছপ গবেষক ও সহকর্মী শাহরিয়ার সিজার রহমান। দীর্ঘদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে এই কচ্ছপ গবেষণায় নিবেদিত রইলেন। শিকারিদের কাছ থেকে উদ্ধার করলেন আরও ৯টি কচ্ছপ। এর মধ্যে ৩টি ছিল পুরুষ। মোট ১২টি কচ্ছপ নিয়ে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের ভেতর আরও একটি কচ্ছপ প্রজননকেন্দ্র গড়ে তুললেন ২০১৭ সালে। শহর ছেড়ে এই উদ্যানকেই নিজের ঠিকানা বানিয়ে ফেলেন তিনি। অনেক প্রচেষ্টার পর ২০১৯ সালে এই কচ্ছপগুলোর ঘরে প্রথম বাচ্চা আসে। গোটা দুনিয়ার কচ্ছপপ্রেমীদের আশা, মহাবিপন্ন এই কচ্ছপ সত্যিই একদিন বুনো পরিবেশে ফিরে যাবে।
সিজারেরও গভীর আত্মবিশ্বাস তাই। এই কচ্ছপগুলোর জন্য একটি ভালো পরিবেশ খুঁজতে থাকেন তিনি। অবশেষে বান্দরবানের আলীকদম থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে মাতামুহুরী সংরক্ষিত এলাকার মেন্নি পাড়ায় একটি ছোট্ট বনের হদিস পান। আয়তন প্রায় ২০০ হেক্টর। বন পেলে কী হবে! এই বনের পাশে ম্রো গ্রামটির বেশির ভাগ মানুষই খাবারের জন্য কচ্ছপ শিকার করেন।
সিজার তাদের সঙ্গে সন্ধি করার চেষ্টা করলেন। স্থানীয় তরুণদের কাজে লাগালেন। ম্রো পাড়ার প্রায় ৫০টি শিশুর শিক্ষার দায়িত্ব নিল ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স। দারুণ এক ব্যাপার! পাহাড়িদের কাছে এই কাজগুলো মনে ধরে গেল। আর এই বন থেকে কচ্ছপ শিকার করবেন না বলে তাঁরা অঙ্গীকার করলেন।
২০২১ সালের পুরোটা সময় পাহাড়ি বনটি নজরে রাখা হলো। তাদের আচরণে পরিবর্তন আসায় পরিকল্পনা করা হলো ভাওয়াল উদ্যান থেকে এই বনে কচ্ছপ ছাড়ার। এগিয়ে এল বন অধিদপ্তর আর টারটল সারভাইভাল অ্যালায়েন্স। ১৮ ডিসেম্বর মোট ১০টি বাচ্চা কচ্ছপ নিয়ে যাওয়া হলো এই পাহাড়ে।
প্রায় ছয় মাস এই পাহাড়ের একটি ছোট্ট আবদ্ধ জায়গায় কচ্ছপগুলো রাখা হলো পরিবীক্ষণের জন্য। দেখা গেল, সব কচ্ছপই ভালো আছে। এরপর কচ্ছপের গায়ে ভিএইচএফ রেডিও ট্রান্সমিটার বসিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো মূল বনে। এই যন্ত্র থেকে পাওয়া সিগন্যালের মাধ্যমে কচ্ছপের চলাচল ও অবস্থা সহজেই বোঝা যায়।
বনে কচ্ছপ ছাড়ার পর প্রতি সপ্তাহে একবার এদের গতিবিধির বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়। বাচ্চাগুলো প্রায় সবাই ভালোভাবে টিকে আছে। কোনো কচ্ছপই আর গ্রামবাসী শিকার করেননি। মেন্নি পাড়ার তরুণেরাই এখন এই কচ্ছপগুলোর ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব নিয়েছে।
আজ ২৩ মে বিশ্ব কচ্ছপ দিবস। ১৯৯০ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। মূলত কচ্ছপ ও কাছিম শিকার বন্ধ করা এবং তাদের আবাসস্থল সংরক্ষণের জন্য সচেতনতা বাড়ানোর জন্যই এই উদ্যোগ। এ দেশে প্রায় ২৫ প্রজাতির কচ্ছপের বেশির ভাগই বিরল। এ দেশে কচ্ছপ সংরক্ষণে শিলার আপন ঘরে ফিরে যাওয়া দারুণ অনুপ্রেরণাময় এক বিরল ঘটনা।