ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটতে দেখা যায় প্রায়ই। জনপ্রিয় তারকা, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, সংবাদকর্মী কিংবা নানা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ফোনালাপ ফাঁস হয়ে ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, এমনটা আমরা দেখেছি। সাধারণত সরকারি সংস্থাগুলো এসব নজরদারির কাজ করে। বাংলাদেশে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) ফোনে আড়ি পাতা ও ফোন ট্র্যাকিংয়ের (অবস্থান শনাক্ত করা) কাজটি করে প্রযুক্তির মাধ্যমে।
স্মার্টফোনের যুগে এসব কাজে ব্যবহৃত হয় গুপ্তচরবৃত্তির সফটওয়্যার, অর্থাৎ স্পাইওয়্যার। পেগাসাস ও আরও কিছু স্পাইওয়্যার রয়েছে, যেগুলো যেকোনো স্মার্টফোনে ঢুকিয়ে দিয়ে ফোনের গ্যালারি, ক্যামেরা, মাইক্রোফোনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যায়। কাজটি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে, তারপরও রাষ্ট্রীয় কিছু সংস্থা এসব স্পাইওয়্যার দিয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের নজরদারিতে রাখে। সাধারণত স্মার্টফোনের অপারেটিং সিস্টেমের কোনো ত্রুটি বা বাগ ব্যবহার করে স্পাইওয়্যার ফোনে ইনস্টল করা হয়।
অনেকেই আতঙ্কে থাকেন, তাঁর ফোন ট্র্যাক করা হচ্ছে কি না! এ ব্যাপারে নেটওয়ার্ক বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বললেন, ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে কি না, এটা ব্যবহারকারীর পক্ষে নিশ্চিত হওয়া খুব সহজ নয়। সরকারি মনিটরিং সংস্থার তালিকা দেখলে তবেই নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে। তবে এসব তালিকা তো সাধারণত প্রকাশ করা হয় না। আবার ধরুন আড়ি পাতা হয়েছে, এমন কোনো সন্দেহভাজনের ফোনে আপনি যদি একাধিকবার কল করেন, পরে আপনার ফোনটিও নজরদারির মধ্যে চলে আসতে পারে।
সুমন আহমেদ আরও জানালেন, একদম নিশ্চিত হতে না পারলেও প্রযুক্তিগত কিছু লক্ষণের কথা অনেকে বলেন। যাঁদের ফোন ট্যাপড হয়েছে বা ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে, এমন কয়েকজন বলেছেন, ফোনকল যখন গ্রহণ করা হয়, তখন একটি শব্দ হয়। আর ফোনে কথা বলার সময় শব্দের মান ভালো থাকে না। তবে অপর প্রান্তে কেউ যদি কথোপকথন ধারণ করে রাখেন (কল রেকর্ড), সে ক্ষেত্রে আইফোন এবং নতুন সংস্করণের অ্যান্ড্রয়েড ফোনগুলো নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ব্যবহারকারীকে জানিয়ে দেয়।
আড়ি পাতা হচ্ছে কি না বুঝতে কিছু বিষয় জেনে রাখুন
স্মার্টফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে কি না বা ফোনের ভৌগোলিক অবস্থান শনাক্ত করা হচ্ছে কি না, তা বোঝা যায় ফোনের কিছু আচরণে। এমনটাই জানালেন প্রযুক্তিবিদেরা। ফোন কলের সময় অস্বাভাবিক শব্দ (ক্লিক বা ট্যাপ করার) শোনা যাবে। আবার অচেনা নম্বর থেকে অদ্ভুত লিখিত বার্তা (মেসেজ) আসবে। এতে বোঝা যাবে স্পাইওয়্যার দিয়ে ফোনে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলছে। এমন অবস্থায় নিরাপদ থাকার উপায় হলো ‘ফ্যাক্টরি রিসেট’ (ফোনের সেটিংস প্রাথমিক অবস্থায় নিয়ে যাওয়া) করা। ট্র্যাক বা ট্যাপড করা হচ্ছে, এমন সন্দেহ হলে সব সময় ভিপিএনও (ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) ব্যবহার করা যেতে পারে।
আরও কিছু বিষয়ে ফোন ব্যবহারকারীরা সতর্ক থাকতে পারেন—
অস্বাভাবিক শব্দ
ফোন কলে কথা বলার সময় যদি ক্লিক করা বা ট্যাপ করার মতো শব্দ শোনা যায়, হতে পারে এটি আড়ি পাতার সংকেত। যদি শুধু একবার একটি কলে এমন শব্দ শোনেন, তাহলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে যদি সব কলে কথা বলার সময় এমন শব্দ শোনা যায়, তাহলে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিন।
ফোন ব্যবহার করা হচ্ছে না, কিন্তু পর্দার আলো জ্বলছে
স্মার্টফোনে কথা বলছেন না, বা কোনো কাজ করছেন না, কিন্তু ফোনের পর্দার (ডিসপ্লে) আলো জ্বলছে—এ ধরনের লক্ষণও দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। যদি অন্য কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি না থাকে, তাহলে এ ধরনের সমস্যার মানে হলো—আপনার ফোনে অন্য কেউ কিছু করছে, যা আপনার ফোন ধরতে পেরেছে। আলো জ্বলার পাশাপাশি ফোনে কিছু নোটিফিকেশনের শব্দ (ডিং) আসতে পারে, ফোনটি কাঁপতে পারে। এর অর্থ হলো, কেউ কোনো ভুয়া নোটিফিকেশন পাঠানোর চেষ্টা করছে।
ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে কি না
ফোনের ক্যামেরা, মাইক্রোফোন অন্য কেউ ব্যবহারের চেষ্টা করলে আইফোনের অপারেটিং সিস্টেমে সেটি ধরা পড়ে। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আইফোনের পর্দায় কমলা বা সবুজ একটি বিন্দু ভেসে ওঠে।
ফোন একা একা বন্ধ হয়ে আবার চালু হচ্ছে
যদি আপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফোনের অপারেটিং সিস্টেম হালনাগাদ (অটোমেটিক আপডেট) করার কোনো সেটআপ না করে থাকেন, তাহলে ফোন নিজে নিজে বন্ধ হয়ে আবার চালু হওয়ার (রিবুট) বিষয়টি নিয়ে সতর্ক হোন। কেউ যদি দূর থেকে আপনার ফোনে প্রবেশের চেষ্টা করে, সে ক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে।
দ্রুত শেষ হচ্ছে ব্যাটারি
ফোন যদি ট্র্যাক করা হয়, অর্থাৎ আপনার মুঠোফোনের অবস্থান কেউ যদি অনুসরণ করে, তাহলে ব্যাটারির চার্জ দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। যেহেতু ফোনের নেপথ্যে স্পাইওয়্যার সব সময় সক্রিয় থাকে, তাই এটি দ্রুত ব্যাটারির চার্জ খেয়ে ফেলে।
ফোন চালু-বন্ধ হতে বেশি সময় নিচ্ছে
বোতাম টিপে ফোন চালু বা বন্ধ (অন/অফ) করতে যদি একটু বেশি সময় লাগে, এটিও স্পাইওয়্যারের কারণে হতে পারে। বন্ধ হওয়ার আগে স্পাইওয়্যার আপনার ফোনের তথ্য নির্দিষ্ট জায়গায় পাঠিয়ে দেয়। তাই ফোন বন্ধ (শাটডাউন) হতে সময় বেশি লাগে।
অদ্ভুত বার্তা
অনেক স্পাইওয়্যার অচেনা (ফোন ব্যবহারকারীর কাছে) নম্বর থেকে অদ্ভুত বার্তা পাঠায়। এই বার্তায় এলোমেলোভাবে অক্ষর ও সংখ্যা থাকে। এগুলো আসলে একটি সংকেত। এর মানে হচ্ছে, সম্ভবত এই বার্তা বা টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে স্পাইওয়্যার আপনার ফোনে ঢোকার চেষ্টা করছে।
ডেটা খরচের মাত্রাতিরিক্ত হার
স্পাইওয়্যার আপনার ফোন ট্র্যাক করার জন্য ফোনে থাকা তথ্যের ওপর নির্ভর করে। তাই এটি আপনার ফোনে থাকা তথ্যের চেয়ে বেশি তথ্য ব্যবহার করতে চায়। যদি দেখেন আপনার যন্ত্রের স্টোরেজ দ্রুত তথ্যে ভরে যাচ্ছে, এটিও স্পাইওয়্যারের কারণে হতে পারে।
ফোন বেশি গরম
ফোন ছুঁয়ে দেখুন। স্বাভাবিকের চেয়ে কি বেশি গরম মনে হচ্ছে? তাহলে ফোনে স্পাইওয়্যার থাকতে পারে।
ওয়েবসাইট বা অ্যাপ অন্য রকম লাগছে
স্পাইওয়্যার বা ম্যালওয়্যার ফোনের পর্দার স্বাভাবিক চেহারা বদলে দেয়। কিছু কিছু ম্যালওয়্যারের কারণে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও অ্যাপ আপনার ফোনে দেখতে অন্য রকম লাগবে।
অচেনা অ্যাপ
নানা কাজের জন্য যেসব অ্যাপ ফোনে ব্যবহার করা হয়, ব্যবহারকারী সেই অ্যাপগুলো চেনেন। ফোনে যদি এমন অ্যাপ দেখেন যা আপনার অচেনা, তবে সচেতন হতে হবে। অপরিচিত অ্যাপ স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে ফোনে প্রবেশ করে।
নিরাপদ ‘এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন’
আড়ি পাতার সুযোগ বা ফোনের অবস্থান অন্য কাউকে জানতে না দেওয়ার জন্য নিরাপদ কৌশল হলো হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যাল, মেসেঞ্জারের মতো অ্যাপ ব্যবহার করে কথা বলা বা বার্তা আদান-প্রদান করা। অর্থাৎ যে অ্যাপগুলো বার্তা আদান–প্রদানে ‘এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন’ প্রযুক্তির সুবিধা দেয়। সহজভাবে বলতে গেলে, এনক্রিপশন হলো সাধারণ কল বা বার্তাকে বিশেষ সাংকেতিক বার্তায় রূপান্তর করে অপর প্রান্তে পাঠানোর পদ্ধতি। সেই সাংকেতিক বার্তা পুনরুদ্ধার করে অপর প্রান্তে সাধারণ বার্তা হিসেবে পৌঁছে দেয় অ্যাপগুলো। কিছু স্পাইওয়্যার কিছুদিনের মধ্যে এই সংকেত ধরে ফেলতে পারে। তবে হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যাল, মেসেঞ্জারের অ্যাপগুলো কয়েক দিন পরপরই এনক্রিপশন পদ্ধতি পরিবর্তন করে। ফলে স্পাইওয়্যার সেই এনক্রিপশন ভেঙে তথ্য উদ্ধার করতে পারে না। এক কথায় বলা যায়, এসব অ্যাপ ব্যবহার করলে ফোনে ট্র্যাকিং ও আড়ি পাতা প্রায় অসম্ভব। আরও নিরাপত্তার জন্য ভিপিএন চালু করে ‘এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন’ সুবিধার অ্যাপ ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই সময়ের বেশি ব্যবহৃত কিছু স্পাইওয়্যার
ফোনে আড়ি পাতা ও ফোনের অবস্থান শনাক্ত করার জন্য অসংখ্য স্পাইওয়্যার রয়েছে। এই সময়ে যে ১০টি স্পাইওয়্যার বেশি ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন দেশে, সেগুলো হলো—অ্যাডভান্সড কি-লগার, কুল ওয়েবসার্চ (সিডব্লিউএস), ফিনস্পাই, গ্যাটর (গেইন), গো কিবোর্ড, হকআই, হান্টবার, লুকটুমি, পেগাসাস ও ফোনস্পাই।
তথ্যঋণ: উইকিহাউ
লেখক: পল্লব মোহাইমেন, সাংবাদিক ও প্রথম আলোর হেড অব নিউ ইনিশিয়েটিভ