ভারতের কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার খুনের ঘটনা তদন্তে বের হয়ে আসছে বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম। তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখছে ডিবি। এরই মধ্যে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার কাছ থেকে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের অনেক অজানা তথ্য মিলছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের এ নেতার বরাত দিয়ে ডিবির একটি সূত্র জানিয়েছে, কলকাতার ফ্ল্যাটে খুন করার পর এমপি আনারের মরদেহের ছবি তোলেন খুনিচক্র। সে ছবি কাজী কামাল আহমেদ ওরফে গ্যাস বাবুর হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছিলেন শিমুল ভূঁইয়া। ছবি পাওয়ার পর শিমুল ভূঁইয়াকে ধন্যবাদ জানান গ্যাস বাবু। মূলত, হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের হয়ে কাজ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের এ নেতা। হত্যাকাণ্ডের পরও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে দফায় দফায় আলাপ হয় গ্যাস বাবুর।
ডিবি জানায়, এমপি আনার খুনের তিন মাস আগে থেকেই হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা করে আসছিলেন গ্যাস বাবু, শিমুল ভূঁইয়া ও মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন। এ তিনজনের একাধিক হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটিংয়ের তথ্যও পেয়েছেন তদন্তকারীরা। এ ছাড়া অন্যতম আসামি শিমুল ভূঁইয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতেও এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।
সংসদ সদস্য হত্যাকাণ্ডে যেন না ফাঁসতে হয়, সেজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অবশ্য করেছিলেন কাজী কামাল আহমেদ ওরফে গ্যাস বাবু। হত্যা পরিকল্পনা সংক্রান্ত সব আলাপচারিতার রেকর্ড মেটাতে ভেঙে ফেলেন নিজের তিনটি মোবাইল ফোন। পরে ফোন হারানোর ব্যাপারে জিডিও করেন থানায়।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, গত শনিবার (৮ জুন) শিমুল ভূঁইয়ার সাভার এলাকার একটি ভাড়া বাসায় অভিযান চালানো হয়। ওই বাসা থেকে একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে ডিবি। ফোনটিতে বাবুর সঙ্গে আনার হত্যা নিয়ে শিমুল ভূঁইয়ার কথোপকথনের অনেক তথ্য রয়েছে। বাবু তার তিনটি মোবাইল ফোন হারানো সংক্রান্ত থানায় যে জিডি করেছেন, তা আসলে নিজেকে রক্ষা করার কৌশল ছিল তার। ওই ফোনগুলো তিনি নিজেই ধ্বংস করেছেন। ফেঁসে যাওয়ার মতো তথ্য থাকায় তিনি সেগুলো ধ্বংস করে দেন।
এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনায় শুধু গ্যাস বাবুই নয়, আড়াল থেকে আখতারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে শামিল হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আরও অনেকেই। পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন একাধিক নেতা। সরাসরি হত্যাকাণ্ডে বা পরিকল্পনায় না জড়ালেও পেছন থেকে ইন্ধন দেন অনেকে। অনেকে আবার খুনের পর দেন বাহবাও। শিমুল ভূঁইয়ার সাভারের বাসা থেকে সদ্য উদ্ধারকৃত মোবাইলগুলো ঘেঁটে এমন অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেতে সক্ষম হয়েছে ডিবি।
পুলিশ বলছে, যেসব নেতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। আর তদন্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল একটি সূত্রের দাবি, সরকারের সবুজ সংকেত মিললেই সন্দেহের তালিকায় থাকা এসব আওয়ামী লীগ নেতাকে একে একে আটকানো হবে গোয়েন্দাদের জালে।
সোমবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বলেছেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার খুনের ঘটনায় আরও অনেকেই গ্রেপ্তার হতে পারেন। আমরা সত্যের কাছাকাছি এসে গেছি। মরদেহটি শনাক্ত হলেই অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারবো।
এ প্রসঙ্গে ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুর কাছ থেকে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে; সেগুলো তদন্ত করে যাচাই-বাছাই চলছে। সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ডে যারা যেভাবে জড়িত, তাদের সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে কলকাতার সঞ্জীবা গার্ডেনসে এমপি আনার খুন হয়েছিলেন যে ফ্ল্যাটে, তার সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার হওয়া মাংসের টুকরোগুলো মানুষের বলে ইতোমধ্যে বেরিয়ে এসেছে ফরেনসিক টেস্টে। নতুন করে ফরেনসিকে পাঠানো হয়েছে নিউটাউনের বাগজোলা খাল থেকে উদ্ধার হওয়া হাড়গোড়। এবার উদ্ধার হওয়া এই মাংস এবং হাড় এমপি আনারের কি না, তা জানতে ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে বলে জানিয়েছে কলকাতা পুলিশ। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য কলকাতায় যেতে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন আনারকন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।
গত ১২ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার। সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে কলকাতায় তার পারিবারিক বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। পরদিন, ১৩ মে চিকিৎসক দেখাতে হবে জানিয়ে দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে গোপালের বাড়ি থেকে বের হন আনার। সন্ধ্যায় ফিরবেন বলেও জানান তিনি। পরে বিধান পার্কের কাছে কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে থেকে ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন তিনি। চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় আনারের মোবাইল নম্বর থেকে তার বন্ধু গোপালের কাছে ম্যাসেজ আসে যে, তিনি দিল্লি যাচ্ছেন এবং সেখানে পৌঁছে তাকে ফোন করবেন।
পরে ১৫ মে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তায় এমপি আনার বন্ধু গোপালকে জানান, তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন এবং ভিআইপিদের সঙ্গে আছেন। তাকে ফোন করার দরকার নেই। একই বার্তা পাঠান বাংলাদেশে তার ব্যক্তিগত সহকারী রউফের কাছেও।
১৭ মে আনারের পরিবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে গোপালকে ফোন করেন। ওই সময় তারা গোপালকে জানান, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তারা। পরিবারের পক্ষ থেকে ওই দিন ঢাকায় থানায় অভিযোগ করা হয়। এরপর থেকে আর এমপি আনারের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
২০ মে এমপি আনারের খোঁজ করতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করে। তারা জানতে পারেন, কলকাতায় বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মোবাইলের লোকেশন একবার পাওয়া গিয়েছিল সেখানকার নিউমার্কেট এলাকায়। এরপর ১৭ মে তার ফোন কিছুক্ষণের জন্য সচল ছিল বিহারে। পরে বুধবার (২২ মে) ভারতের এনডিটিভির খবরে বলা হয়, কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনসের একটি ফ্লাটে এমপি আনারকে খুন করা হয়েছে।