সন্তানদের পড়াতে একাকী সংগ্রাম করছিলেন পোশাকশ্রমিক সেই নারী

0
103
নারী

পোশাকশ্রমিকের কাজ করে বড় মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াচ্ছিলেন। স্বপ্ন ছিল, ছেলেরা একদিন প্রকৌশলী হয়ে মায়ের সব ইচ্ছা পূরণ করে দেবে। তার আগেই প্রাণ হারালেন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রামের বাসিন্দা সেই নারী (৪২)।

ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় গত শুক্রবার রাতে চলন্ত বাসে ওই নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন বাসের চালক ও চালকের সহকারীরা। বাধা দিলে চলন্ত বাস থেকে তাঁকে সড়কে ফেলে দেওয়া হয়। দুই দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর গতকাল রোববার বেলা ১১টার দিকে ওই নারীর মৃত্যু হয়। অভিযুক্ত বাসচালক রাকিব মিয়া (২১), চালকের সহকারী আনন্দ দাস (১৯) ও আরিফ মিয়াকে (২১) গত শনিবার গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

গতকাল সন্ধ্যায় কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে ওই নারীর লাশ আনা হয়। এশার নামাজের পর স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন মসজিদের সামনে জানাজা শেষে এলাকার কবরস্থানে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। সরেজমিন ওই নারীর বাড়িতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য চোখে পড়ে।

বাড়িতে লাশ আনার পর স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশের পরিবেশ। চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি এলাকাবাসীরাও। মেয়ের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে কান্না থামাতে পারছিলেন না ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ মা। তিনি বারবার আহাজারি করে বলছিলেন, তাঁর মেয়ের কী অপরাধ ছিল, কেন তাঁকে অল্প বয়সে এমন নির্মম হত্যার শিকার হতে হলো?

তিন সন্তান মায়ের লাশ দেখে কিছুক্ষণ পরপর কেঁদে উঠছিল। স্বজনেরা তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও কিছুতেই থামানো যাচ্ছিল না। ছোট ছেলের আর্তনাদে বন্ধুরা তাঁকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমাদের নিয়ে মায়ের কত স্বপ্ন ছিল। কত কষ্ট করেছেন মা আমাদের জন্য। আমরা তো মায়ের জন্য কিছুই করতে পরলাম না। আমরা এখন কই যাব?’

ভাই-বোনেরাও যেন লাশ দেখে শোকে পাথর হয়ে গেছেন। বোনের শোকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেউ কান্না করছেন, কেউ আবার অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন।
ওই নারীর এক বড় ভাই বলেন, তাঁরা পাঁচ ভাই আর চার বোন। প্রায় ১৫ বছর আগে একই উপজেলায় এই বোনকে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় বিয়ের তিন থেকে চার বছর পরই বিচ্ছেদ ঘটে। তখন ছোট ছোট তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসেন বোন। এরপর কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে সন্তানদের মানুষ করতে ভালুকায় চলে যান। সেখান থেকে শ্রীপুরে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। এই কাজ করেই মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলেকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়াচ্ছিলেন। বোনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন তিনি।

গত শুক্রবার রাতের ঘটনায় গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তির পর ওই নারীর সঙ্গে পরিবারের লোকদের কথা হয়। তিনি তাঁদের জানিয়েছেন, শুক্রবার রাতে পোশাক কারখানার কাজ শেষে আনুমানিক পৌনে ৯টার দিকে শ্রীপুর থেকে ভালুকা বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটি বাসে ওঠেন। ভালুকা আসতে আসতে বাসের সব যাত্রী বিভিন্ন স্থানে নেমে যান। বাসটি ভালুকার জামিরদিয়া এলাকায় এলে চালক ও চালকের দুই সহকারী ওই নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। বাধা দেওয়ায় চলন্ত বাস থেকে ওই নারীকে মারধর করে ফেলে দেন চালক ও চালকের দুই সহকারী।

সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুই দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর রোববার বেলা ১১টার দিকে তিনি মারা যান। মাথায় গুরুতর আঘাতের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

এ ঘটনায় ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে শুক্রবার রাতেই ওই নারীর এক ভাই বাদী হয়ে ভালুকা থানায় মামলা করেন। ভালুকা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল হোসেন জানান, হত্যাচেষ্টা মামলাটি এখন হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.