বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে এফ মাইনর

0
100
এফ মাইনর ব্যান্ডের সদস্যরা।

গারো পাহাড়ে বেড়ে উঠেছেন দিবা চিছাম। পড়েছেন শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে সীমান্তঘেঁষা গারো পাহাড়ের স্কুলে, থেকেছেন হোস্টেলে। স্কুলে টেবিলকে তবলা বানিয়ে গান করে বন্ধুদের মাঝে পরিচিতি মিলেছিল তাঁর।

তবলাবাদকের খোঁজ করছিলেন তাঁর শিক্ষক, বন্ধুরা একবাক্যে দিবার নাম নিয়েছে। বিস্ময়ের ঘোরে শিক্ষক প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি পারবে?’ দিবা বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি তো তবলা বাজাতে পারি না, টেবিল বাজাতে পারি।’

তবে সেই দিন সুযোগ মেলেনি ১০ বছর বয়সী দিবার। সেই দিবা কাহন ও ড্রামস বাজান; দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের প্রথম ব্যান্ড এফ মাইনর–এর ড্রামার ও কাহনবাদক তিনি।

ত্রিপুরা, গারো, চাকমা, মারমা, হাজংসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষার গান শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরতে ২০১৬ সালের ২৮ অক্টোবর যাত্রা করেছে ব্যান্ডটি। সাত বছরের পথচলায় বাংলায় ‘আমি নিশি রাইতের জংলা ফুল’, গারো ভাষায় ‘পরাণ প্রিয়’, ত্রিপুরা ভাষায় ‘তুরু রুতু তুরু রু’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত গান উপহার দিয়েছে ব্যান্ডটি।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পার্কে প্রথম আলোর সঙ্গে আড্ডা দেন ব্যান্ডটির পাঁচ সদস্য নাদিয়া রিছিল, একিউ মারমা, দিবা চিছাম, গ্লোরিয়া মান্দা ও পিংকি চিরান।

‘আমরা দেখতে বাঙালিদের মতো নয়। এমনিতেই চলতে–ফিরতে অনেক সময় টিজিংয়ের শিকার হতে হয়েছে। আর বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যান্ড মানে শুধু ছেলেদের গানের দল। মেয়েরা কেন ব্যান্ড করবে, এই ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েছি।’ বলছিলেন একিউ মারমা; তিনি এফ মাইনর–এর কি–বোর্ডিস্ট। রাঙামাটির মেয়ে একিউ পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় এক এম্বাসিতে চাকরি করছেন, সঙ্গে গানও।

এফ মাইনর ব্যান্ডের সদস্যরা।

একিউ মারমার সঙ্গে যোগ করলেন ব্যান্ডটির ভোকালিস্ট পিংকি চিরান, ‘এফ মাইনরকে অনেকে ভালোভাবে নিয়েছে, অনেকে হাসাহাসি করেছে। অনেকে বলেছে, দু–এক বছরের বেশি এই ব্যান্ড টিকবে না।’ শেরপুরের নালিতাবাড়ীর মেয়ে পিংকি চিরান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীতে স্নাতকোত্তর করেছেন; ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য তিনি। শৈশব থেকেই নাচ ও গান করেছেন তিনি।

‘অনেকে ভাবেন, মেয়েদের এই ধরনের প্ল্যাটফর্ম পাওয়া খুব সহজ। এটা ভুল ধারণা। আমাদের জায়গায় তোমরা দাঁড়িয়ে দেখ, আমাদের কতটা সংগ্রাম করতে হয়েছে।’ পিংকির সঙ্গে যোগ করলেন ব্যান্ডের আরেক প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও গিটারিস্ট নাদিয়া রিছিল; গানও করেন তিনি। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের মেয়ে নাদিয়ার বেড়ে ওঠা ঢাকায়, তিনিও শৈশবে গান করেছেন। পড়াশোনা শেষ করে খণ্ডকালীন চাকরি করছেন।

ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট গ্লোরিয়া মান্দার জন্মও হালুয়াঘাটে, তবে বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। মাধ্যমিকে পড়াকালে গিটার বাজানো শেখেন। ছায়ানটে গান শিখেছেন। বাংলা কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগে স্নাতকে পড়ছেন।

অনেকটা খালি হাতে নেমে পড়েছিলেন পিংকি, নাদিয়ারা। গিটার, ড্রামস—কিছুই ছিল না। ‘আমি নিশি রাইতের জংলা ফুল’ গানের সুরকার ও গিটারিস্ট যাদু রিছিল ও গানটির গীতিকবি বাবুল ডি নকরেকের কাছ থেকে উপহার পাওয়া দুটি গিটারই ছিল অবলম্বন।
পরে শো করে টাকা জমিয়ে ইলেকট্রিক গিটার, ড্রামস কিনেছেন তাঁরা। সাত বছর ধরে তিলে তিলে স্বপ্নের ভিত রচনা করেছেন তাঁরা, কণ্টকাকীর্ণ পথকে কুসুমাস্তীর্ণ পথে পরিণত করেছেন। বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের নিজেদের ভাষার গানকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিশ্বজুড়ে। ভবিষ্যতে সাঁওতাল, ওঁরাওদের গানও করবেন তাঁরা।

এফ মাইনর ব্যান্ডের সদস্যরা।

পিংকি চিরান জানান, ত্রিপুরা, গারো, চাকমা, মারমাসহ আটটি জাতিগোষ্ঠীর লোককাহিনিকে গানে গানে তুলে আনবেন এফ মাইনর। সেসব মৌলিক গান নিয়ে প্রথম অ্যালবাম করারও পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। ইতিমধ্যে কয়েকটি গানের কাজ করছে ব্যান্ডটি।

ব্যান্ডটি শ্রোতাদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গে স্বীকৃতিও পেয়েছে। গত মাসে সানসিল্ক-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে, এর আগে অনন্যা শীর্ষ দশ ২০১৯ পুরস্কারসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছে এফ মাইনর।
এফ মাইনর কেন

২০১৬ সালে শিল্পী যাদু রিছিল ও মাদল ব্যান্ডের গিটারিস্ট অন্তর স্কুর সমন্বয়ে পিংকি চিরান, নাদিয়া রিছিল ও ঐশ্বর্য চাকমাকে নিয়ে যাত্রা করে এফ মাইনর। ফার্মগেটে আড্ডা থেকে ব্যান্ডের ধারণাটি তাঁরা পান। পিংকির ভাষ্যে, ‘আমাদের বাপ–দাদাদের আমলের গানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। সেই গানগুলোকে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরার পরিকল্পনা থেকেই এই ব্যান্ডের যাত্রা।’

২০১৮ সালে ঐশ্বর্য চাকমা ঢাকার বাইরে চলে যাওয়ায় তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। সেই বছরই ব্যান্ডে যোগ দেন একিউ মারমা, দিবা চিছাম ও গ্লোরিয়া মান্দা। মাঝে আরও কয়েকজন অতিথি শিল্পী এলেও ব্যান্ডের বর্তমান লাইনআপে রয়েছেন এই পাঁচ শিল্পী।
যাদু রিছিল ও অন্তর স্কুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন পিংকি। ব্যান্ডের নাম এফ মাইনর কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে পিংকি বলেন, ‘এফ মাইনর নামটা অর্থবহ। এটি একদিকে গিটারের কর্ডের নাম, আবার এফ দিয়ে ফিমেল, ফ্রিডম, ফাইটারও হয়। নারী হিসেবে নিজেদের প্রকাশের জন্য এটি অর্থবহ বর্ণ। আর আমরা মাইনর কমিউনিটি থেকে এসেছি। দুইয়ের সম্মিলনে এফ মাইনর।’

বর্তমান লাইনআপ
নাদিয়া রিছিল
একিউ মারমা
দিবা চিছাম
গ্লোরিয়া মান্দা
পিংকি চিরান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.