অপ্রতুল ক্যান্সার চিকিৎসা বিদেশমুখী রোগী

0
196
অপ্রতুল ক্যান্সার চিকিৎসা

ক্যান্সারে আক্রান্ত কুমিল্লার মোহাম্মদ আনোয়ার এক বছর ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। এখানে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তিনি। জানালেন, ২০২১ সালে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর ক্যান্সার শনাক্ত হয়। পরে তাঁকে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। দুই মাস ঘোরাঘুরির পর ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান তিনি।

চিকিৎসকরা তাঁকে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেন। তবে এরপর সংশ্নিষ্ট চিকিৎসকের কাছে পৌঁছাতেই দু’দিন কেটে যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লেগে যায় আরও সপ্তাহখানেক। মেডিকেল বোর্ড তাঁকে ভর্তির সিদ্ধান্ত দিলেও হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা ছিল না। এজন্য প্রতিদিনই খোঁজখবর নিতে তাঁকে হাসপাতালে আসতে হয়। দীর্ঘ ভোগান্তি ও পরিবহন খরচ কমাতে শেষমেশ মহাখালী হাসপাতালের পাশেই একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন তিনি। তিন মাস অপেক্ষার পর অস্ত্রোপচারের সিরিয়াল মেলে।

দুই মাস আগে তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এখন প্রয়োজন কেমোথেরাপির। এ থেরাপি পেতে আরও দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

আনোয়ারের অভিযোগ, ক্যান্সার হাসপাতালে দালালের অভাব নেই। দালালচক্র অর্থের বিনিময়ে শয্যা নিয়ে দেয়। অনেকেই শয্যা পেতে উচ্চপর্যায় থেকে তদবির করান। ফলে গ্রাম থেকে আসা দরিদ্র মানুষ চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। টাকার অভাবে অনেকেই সেবা না নিয়েই হাসপাতাল ছাড়েন। এ ছাড়া গত ছয় মাসে ক্যান্সারসহ ৫৩ ধরনের ওষুধের দাম দু’দফা বাড়ানো হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে বেড়েছে শয্যার ভাড়া।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ভোগান্তি এড়াতে ও দ্রুত চিকিৎসা পেতে বিত্তবানরা বিদেশমুখী হচ্ছেন। বুধবার ও বৃহস্পতিবার দুই দিন অন্তত ১৫ রোগী ও তাঁদের স্বজনের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

৫০০ শয্যার এ হাসপাতালে বর্তমানে রোগী ভর্তি রয়েছেন ৬০০ জনের ওপরে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার সময় হাসপাতালের নিচতলায় বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। অন্তত দুইশ রোগী টিকিট সংগ্রহের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। টিকিট পাওয়ার পর দ্বিতীয় তলায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার জন্য আবারও দাঁড়াতে হচ্ছে লাইনে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর অনেকে ক্লান্ত হয়ে ফ্লোরে বসে পড়ছেন। রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজনের চোখেমুখেও রাজ্যের ক্লান্তি।

দেশের ক্যান্সার রোগী নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো নিবন্ধন নেই। বছরে কত মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন ও মারা গেছেন, তার হিসাব সরকারের কাছে নেই।

তবে গ্লোবাল ক্যান্সার ইনসিডেন্স, মর্টালিটি অ্যান্ড প্রিভিলেন্স (গ্লোবোক্যান) পরিসংখ্যান ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অধীন ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের (আইএআরসি) সর্বশেষ তথ্যানুসারে, প্রতি বছর গড়ে দেড় লাখ নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। তাঁদের এক-তৃতীয়াংশ রোগীই চিকিৎসার বাইরে থাকছেন। আক্রান্তের মধ্যে মৃত্যু হচ্ছে ১ লাখ ক্যান্সার রোগীর। দেশে ৩০০ ধরনের ক্যান্সার রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ১০ ধরনের ক্যান্সার বেশি দেখা দিচ্ছে। দেশে ক্যান্সার চিকিৎসা অপ্রতুল থাকায় প্রতিবছর বিদেশমুখী হচ্ছেন বিপুলসংখ্যক রোগী।

বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরামের (বিওটিওএফ) হিসাবে, প্রতিবছর গড়ে আট লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। এতে খরচ হচ্ছে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার। বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের সিংহভাগই ক্যান্সারের রোগী। দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসার সুযোগ সীমিত।

দ্রুত এ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ জরুরি বলে মনে করছেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, দেশে ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও অপ্রতুল। এ ছাড়া ক্যান্সারে আক্রান্তের কথা শুনলেই দ্রুত চিকিৎসার জন্য মানুষ বিদেশে ছোটে। প্রতিবেশী দেশগুলো ক্যান্সারের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এখানে আমাদের ঘাটতি রয়েছে।

দেশে বর্তমানে ১৫ থেকে ১৬ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত। বিশ্ব সংস্থা সংস্থার মানদ অনুযায়ী, প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে একটি ক্যান্সার কেন্দ্র দরকার। সেই হিসাবে দেশে ক্যান্সার কেন্দ্রের প্রয়োজন ১৬০টি। তবে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে আছে ৩০টিরও কম। এসব ক্যান্সার হাসপাতালও আবার রাজধানীকেন্দ্রিক।

হাসপাতালের পাশাপাশি রয়েছে যন্ত্রপাতি সংকটও। ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৮০ শতাংশের রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয়। রোগীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ৩০০টি রেডিওথেরাপি মেশিন দরকার। তবে সরকারিভাবে ৯টি কেন্দ্রে ১৭টি রেডিওথেরাপি মেশিন আছে। তার ১১টি-ই নষ্ট।

কেমোথেরাপি কেন্দ্রও চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এ ছাড়া এ বিপুল সংখ্যক রোগীর সেবায় মাত্র ৩০০ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। নেই ক্যান্সার শনাক্তকরণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, প্রতিদিন প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ রোগীকে কেমোথেরাপি ও ৪০০ রোগীকে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয় এখানে। হাসপাতালে শয্যা সংকটের কারণে সব রোগীকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। এ কারণে স্থিতিশীল রোগীকে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি দেওয়ার পর ছেড়ে দেওয়া হয়। রোগীরা তার পর নিজ দায়িত্বে যে কোনো জায়গায় থেকে চিকিৎসা চালিয়ে যান।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা হাসপাতালে রেডিওথেরাপির সিরিয়ালের জন্য তিন থেকে চার মাস অপেক্ষা করতে হয় বলে অভিযোগ করেছেন রোগীরা। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য করছে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট। অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা না থাকায় দেশের সব জেলার রোগী এ হাসপাতালেই ভিড় করেন। ফলে রোগী বাগিয়ে নিতে হাসপাতালের অধিকাংশ চিকিৎসকই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগতভাবে ক্লিনিক খুলেছেন। এসব ক্লিনিকে রোগীর কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়েরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। অনেকে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। এ অবস্থার মধ্যেই অন্যান্য দেশের মতো আজ শনিবার পালিত হবে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য- ‘বৈষম্য কমাই ক্যান্সার সেবায়’। দিবসটি উপলক্ষে মূল অনুষ্ঠান রোববার জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা হাসপাতাল অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকার কথা রয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক নিজামুল হক সেবা নিয়ে অভিযোগ স্বীকার করেন। তিনি বলেন, তিনশ শয্যার হাসপাতালে এখন ৫০০ জনের সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে। হাসপাতালে দৈনিক বহির্বিভাগে প্রায় ১ হাজার রোগী চিকিৎসা নেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৫০০ রোগীকে ভর্তি করে চিকিৎসার দেওয়া উচিত। কিন্তু এ ধরনের একজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি করা হলে অন্তত এক মাস রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। এতে প্রতিদিনই রোগীর চাপ বেড়ে যায়। এ ছাড়া ক্যান্সার রোগীদের অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা থাকে। ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীরা অপেক্ষা করতে চান না।

তিনি জানান, রোগীর সুবিধার জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশের আট বিভাগে আটটি পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার সেন্টার স্থাপনের কাজ চলছে। এগুলোর কাজ শেষ হলে ঢাকায় রোগীর চাপ কমবে।

জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসা বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি জনবল প্রস্তুত করা ও চিকিৎসার পরিধি বাড়ানোর দিকে এখনই নজর দিতে হবে।

ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহূত অধিকাংশ যন্ত্রপাতি নষ্ট। এগুলো দ্রুত মেরামত ও প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। ক্যান্সার প্রতিরোধের দিকেও জোর দিতে হবে।

বরিশালে নির্মিত হচ্ছে আধুনিক হাসপাতাল: বরিশাল ব্যুরো জানায়, বরিশালে ক্যান্সার রোগীদের উন্নত চিকিৎসা দিতে নির্মিত হচ্ছে আধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল। গণপূর্ত অধিদপ্তর বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালের উল্টোদিকে নির্মাণ করছে ১৭ তলা ক্যান্সার হাসপাতাল ভবন।

বরিশাল গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী কামাল হোসেন বলেন, ২০২১ সালের আগস্টে ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। এটি নির্মাণ করতে ব্যয় হবে ১০০ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত নির্মাণ কাজের ২০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে ভবন নির্মানকাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে না বলে জানিয়েছেন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী কামাল হোসেন।

শেবাচিম হাসপাতালে ২৭ শয্যার একটি ক্যান্সার ইউনিট থাকলেও চিকিৎসক এবং পরীক্ষণ যন্ত্রপাতি সংকটে যথাযথ চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রোগীদের চিকিৎসা নিতে রাজধানী ঢাকায় যেতে হয়। ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেক রোগী চিকিৎসার অভাবেই মারা যান।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.