রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক একসময় দেশের ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল। উদ্যোক্তাদেরও অর্থায়নের প্রধান উৎস ছিল ব্যাংকটি। জনতা ব্যাংকের অর্থায়নে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন দেশের অনেক শিল্পোদ্যোক্তা। সেই ব্যাংকটি এখন দেশের খেলাপি ঋণে শীর্ষ ব্যাংক।
জনতা ব্যাংকের নিজস্ব নথিপত্র অনুযায়ী, গত তিন মাসে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এর ফলে ব্যাংক খাতের সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ এখন এ ব্যাংকের। গত মার্চ শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। জুনে তা বেড়ে হয়েছে ২৮ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। তাতে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৩০ দশমিক ৪৩ শতাংশই এখন খেলাপি। মার্চেও এ হার ছিল ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। খেলাপি ঋণের বড় অংশ অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া।
জনতা ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ৪০ হাজার কোটি টাকায় বড় তিন প্রভাবশালী শিল্প গ্রুপের, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের প্রায় ৪২ শতাংশ। গত জুন শেষে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৪ হাজার ২০৭ কোটি টাকায়। এক যুগের বেশি সময় ধরে ব্যাংকটি ধীরে ধীরে খারাপ হতে শুরু করে। একে একে ব্যাংকটি ছেড়ে যায় ভালো শিল্প গ্রুপগুলো। আর তার বিপরীতে শীর্ষ গ্রাহকের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বিতর্কিত ও বেনামি অনেক গ্রুপ।
বড় প্রভাবশালী গ্রাহকের কাছে শুধু জনতা ব্যাংক নয়, পুরো ব্যাংক খাত জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা না থাকায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
মুস্তফা কে মুজেরী, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক
এই সময়ে বড় ধরনের ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে ব্যাংকটিতে। তাতে খেলাপি হয়ে পড়েছে এসব ঋণ। বারবার পুনঃ তফসিল করার পরও এসব ঋণ আদায় হচ্ছে না। পুরো ব্যাংক খাতের সার্বিক খেলাপি ঋণ যেখানে ১০ শতাংশের কম, সেখানে জনতা ব্যাংকের খেলাপি তিন গুণ বেশি। একদিকে তিন গ্রুপের কাছে ঋণের বড় অংশ পুঞ্জীভূত, অন্যদিকে খেলাপি ঋণে শীর্ষে—এ দুইয়ে মিলিয়ে বড় ধরনের সংকটে এখন রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলারের যে ঋণ দিয়েছে, তার বিপরীতে শর্ত দেওয়া হয় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। আইএমএফের ওই শর্তের পর বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয় জনতা ব্যাংককে। এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন।
তাতেও আর্থিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটছে না। বরং কিছু গ্রুপকে নতুন করে ঋণ ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া অব্যাহত রেখেছে ব্যাংকটি। বিশেষ বিবেচনায় যার অনুমোদনও দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ অবস্থায় ব্যাংকটিকে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থ দিয়ে গঠিত রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে নেওয়া ডলারের ঋণও ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকটি। ফলে জনতা ব্যাংকের গ্রাহকদের ইডিএফ সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে গত মে মাসে যোগ দিয়েছেন আবদুল জব্বার। তিনি বলেন, ‘গ্রাহকেরা কিস্তির টাকা ফেরত না দেওয়ায় অনেক ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মের মধ্যে থেকে কোনো গ্রাহক ঋণ নিয়মিত করতে চাইলে তা করা হবে। কাগজে-কলমে আমরা ব্যাংকের স্বাস্থ্য ঠিক করতে চাই না। প্রকৃত যা অবস্থা, তাই দেখানো হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
আমানত বেড়েছে কম, ঋণ বেড়েছে বেশি
২০২১ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের আমানত ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, ওই সময়ে ঋণ ছিল ৬৯ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। গত জুন শেষে আমানত বেড়ে হয় ১ লাখ ৭ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা। আর ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ দেড় বছরে ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে ৬ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। আর এ সময়ে ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানত যতটা বেড়েছে তার চার গুণ বেড়েছে ঋণ। গত দেড় বছরে ব্যাংকটি একাধিক সিন্ডিকেট বা জোটভুক্ত ঋণে যুক্ত হয়, আবার বড় গ্রাহকদেরও নতুন করে ঋণ দেয়।
জনতা ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির শীর্ষ গ্রাহক বেক্সিমকো গ্রুপ। এরপরই শীর্ষ গ্রাহকের তালিকায় আছে এস আলম ও ওরিয়ন গ্রুপ। এই তিন গ্রুপের কাছে ব্যাংকটির ঋণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে একক গ্রাহকের যে ঋণসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, এ তিন গ্রাহকের ঋণ সেই সীমার বেশি। এসব ঋণের ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জনতা ব্যাংকের মতিঝিলের স্থানীয় কার্যালয়ের ৩১ হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ২২ হাজার কোটি টাকা বেক্সিমকো গ্রুপের। জনতা ভবন করপোরেট শাখার ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণের বড় অংশই ওরিয়ন, এননটেক্স ও থার্মেক্স গ্রুপের। আর চট্টগ্রামের সাধারণ বিমা করপোরেট শাখার প্রায় সব ঋণই এস আলম গ্রুপের।
নতুন করে বেশি পরিমাণ ঋণ দেওয়ার ও চাহিদামতো আমানত না বাড়ায় ব্যাংকটি তারল্যসংকটে পড়েছে। আবার কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের কাছে দেওয়া আমানতও ব্যাংকটি ফেরত পাচ্ছে না। ফলে এখন দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন টাকা ধার করতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। মূলত সরকারি আমদানি দায় পরিশোধে ডলার কেনার জন্য ব্যাংকটিকে এ টাকা ধার করতে হচ্ছে।
এ জন্য ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেসব বড় গ্রাহক বিশেষ বিবেচনায় একক গ্রাহকের সীমার বেশি ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের ঋণের পরিমাণ আর বাড়াবে না। এসব গ্রাহক যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করবেন, শুধু সেই পরিমাণ ঋণ নতুন করে নিতে পারবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘বড় প্রভাবশালী গ্রাহকের কাছে শুধু জনতা ব্যাংক নয়, পুরো ব্যাংক খাত জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা না থাকায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। নিয়ম মেনে ঋণ না দেওয়ায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন এ ব্যাংকটির এত ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। আবার খেলাপিদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিও উদার। এ জন্য অনেকেই ইচ্ছা করে ঋণ শোধ করছে না। এসব ব্যাংককে নানা ধরনের সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখছে সরকার। এর ফলে মানুষের আমানত আরও ঝুঁকিতে পড়ছে। এই ব্যাংক খাত দিয়ে দেশের অর্থনীতির উন্নতি করা সম্ভব না।’
খেলাপি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি
২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১২ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। গত জুনে যা বেড়ে হয়েছে ২৮ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। তাতে দেড় বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ফলে ব্যাংকটি বড় অঙ্কের মূলধন-সংকটে পড়েছে। গত জুনে মূলধন ঘাটতি বেড়ে হয় ২ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে যা ছিল ১ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির ১৩ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু সংরক্ষণ করতে পারে ৫ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। বাকি ৮ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকটিকে ২০৩১ সাল পর্যন্ত সময় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় মুনাফা থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক এ বিষয়ে বলেন, ‘জনতা ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি করতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিযুক্ত সমন্বয়ক কাজ করছেন। আগে যেসব অনিয়ম হয়েছে ও ঋণ দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে কিছু বলা সম্ভব না। সব ঋণ প্রস্তাব পর্ষদেও আসে না।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যদি না থামে, তাহলে সব সময় পাহারা দিয়ে এই ব্যাংক ঠিক রাখা সম্ভব না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকেরা কিছু ঋণ খেলাপি করেছেন, এ জন্য খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ব্যাংকটিকে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
ব্যাংকটির জুনভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, ক্রিসেন্ট গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির আটকা ১ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো রূপালী কম্পোজিট, ক্রিসেন্ট লেদার ও ক্রিসেন্ট ট্যানারি। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এম এ কাদের। এর বাইরে কাদেরের বড় ভাই আবদুল আজিজের রিমেক্স ফুটওয়্যারের কাছে আটকা ১ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজক ও জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার।
রতনপুর গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকা জনতা ব্যাংকের ১ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো রতনপুর শিপ রি-সাইক্লিং, এসএম স্টিল রি-রোলিং মিলস ও মডার্ন স্টিল মিলস। এই গ্রুপের মালিক নোয়াখালীর মাকসুদুর রহমান, তিনি সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের সাবেক পরিচালক। চৌধুরী নিটওয়্যার ও চৌধুরী টাওয়েলের খেলাপি ঋণ ৬২৫ কোটি টাকা, প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধার বিদেশে পালিয়ে যাওয়া বিসমিল্লাহ গ্রুপের মালিক খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী।
রাজধানীর হাবিব হোটেলের (হলিডে ইন) খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৯৫ কোটি টাকা। এ হোটেলের মালিক বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা আলম আহমেদ। এ ছাড়া জনতা ব্যাংকে থার্মেক্স গ্রুপের ঋণ ৫৬৯ কোটি টাকা, গ্রাম-বাংলা এনপিকে ফার্টিলাইজারের ৫৫২ কোটি টাকা, এননটেক্স গ্রুপের এমএইচ গোল্ডেন জুট ও শাইনিছ নিটের ঋণ ৪৬৭ কোটি টাকা। যার সবই খেলাপি।
ইব্রাহিম গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৪২২ কোটি টাকা, ডেলটা কম্পোজিট নিটের ৩৭৩ কোটি টাকা ও লিথুন ফেব্রিকসের ২৯৭ কোটি টাকা। আসিফ গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ২৭৯ কোটি টাকা, লকপুর গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের ২৬২ কোটি টাকা, হ্যানসল পেপার মিলের ২৬৫ কোটি টাকা, এমবিএ গার্মেন্টসের ১৬৮ কোটি টাকা, আফিল জুট মিলের ১৬৩ কোটি টাকা, ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের ১৬২ কোটি টাকা, শাহনেওয়াজ গ্রুপের ১৫৯ কোটি টাকা, ল্যান্ড মার্ক ফেব্রিকসের ১৫৮ কোটি টাকা ও অ্যালাইন অ্যাপারেলসের ১৪৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শীর্ষ-২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে আটকা পড়েছে ব্যাংকটির ৯ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটি চলতি বছর এসব গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৩২ কোটি টাকা। ২০২২ সালের পুরো সময়ে আদায় হয়েছিল ৯১ কোটি টাকা।
মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ব্যাংক খাত যেভাবে চলছে তাতে এই ব্যাংক খাত দিয়ে দেশের অর্থনীতির উন্নতি করা সম্ভব না।